মেমফিসের সংগ্রহগুলো কোথায়? স্মিথ জিজ্ঞাসা করলেন। আলাপ শুরু করার জন্যই প্রশ্নটা করেছেন।
ওইখানে, লোকটা রূঢ়ভাবে জবাব দিল, মাথা নেড়ে ঘরের অপর প্রান্ত দেখাল।
তুমি কি মিশরীয়? স্মিথ আবার প্রশ্ন করলেন। অ্যাটেনডেন্ট এবার তার অদ্ভুত কালো চোখ তুলে প্রশ্নকর্তার দিকে তাকাল। তার চোখ দুটো কাঁচের মতো চকচকে। তাতে রয়েছে এক কুয়াশাচ্ছন্ন শুকনো ঔজ্জ্বল্য। কোনো মানুষের এরকম চোখ স্মিথ কখনও দেখেননি। অ্যাটেনডেন্টের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে দেখলেন, লোকটার চোখের গভীরে যেন আবেগ জমে উঠছে। যেটা বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে ঘৃণা আর আতঙ্কে রূপ নিল।
না, মশিয়ে, আমি ফরাসি। একথা বলে লোকটা হঠাৎ ঘুরে বসে আবার পালিশে মন দিল।
স্মিথ অবাক হয়ে লোকটার দিকে আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর হলের এক কোণে চেয়ারে বসলেন। জায়গাটা একটা দরজার পেছনে। চেয়ারে বসে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য প্যাপিরাসের পাতা থেকে নোট করতে শুরু করলেন। কিন্তু কাজে মন বসাতে পারলেন না। বারবার স্ফিংসের মতো বুড়ো অ্যাটেনডেন্টের চেহারা আর পার্চমেন্টের মতো তার চামড়ার কথা মনে পড়তে লাগল।
ওরকম চোখ কোথায় দেখেছি? স্মিথ নিজেকে প্রশ্ন করলেন। চোখের দৃষ্টি অনেকটা সরীসৃপের মতো। সাপের চোখে যে ঝিল্লি আছে, হয়তো বুড়োর চোখেও তাই আছে। স্মিথ হাসলেন। প্রাণিবিদ্যার কথা তার মনে পড়ে যাচ্ছে। ঝিল্লি আছে বলেই হয়তো তার চোখে চকচকে ভাব রয়েছে। কিন্তু ওখানে আরও কিছু রয়েছে। আমি পরিষ্কার দেখেছি শক্তি আর জ্ঞানের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ওই দুই চোখে ফুটে উঠেছে। তা ছাড়া আরও আছে চরম ক্লান্তি আর প্রচণ্ড হতাশা। হয়তো এসব আমার কল্পনা। কিন্তু প্রথম দর্শনে কেউ আমার মনে এরকম ছাপ ফেলেনি। ঈশ্বর, লোকটাকে আরেকবার দেখতেই হবে। স্মিথ চেয়ার থেকে উঠে মিশরিয় সংগ্রহশালায় ঢুকলেন। কিন্তু যে লোক তাঁর কৌতূহল জাগিয়েছে, তাকে দেখতে পেলেন না।
স্মিথ আবারও সেই নির্জন কোনায় বসে নোট করতে লাগলেন। যে সমস্ত তথ্য তার দরকার সবগুলোই তিনি প্যাপিরাসে পেয়েছেন। মনে থাকতে থাকতে সেগুলো লিখে ফেলা দরকার। কিছুক্ষণ তার পেন্সিল কাগজের ওপর দ্রুত চলতে লাগল। কিন্তু একটু পরেই লাইনগুলো আর এক রেখায় রইল না। শব্দগুলো পরস্পরের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে। অবশেষে পেন্সিলটা মেঝেতে পড়ে গেল। স্মিথের মাথা বুকের ওপর ঝুলে পড়ল। দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তির ফলে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। নির্জন কোণে দরজার পেছনে তাঁর ঘুম এতটাই গম্ভীর হলো যে সিভিল গার্ডের চলাচলের শব্দ, দর্শকদের পদধ্বনি এমনকী মিউজিয়াম বন্ধ হওয়ার তীক্ষ্ণ, কর্কশ ঘণ্টা ধ্বনিও তার ঘুম ভাঙাতে পারল না।
সন্ধ্যার তরল অন্ধকার গাঢ় হতে হতে রাতের ঘন অন্ধকারে পরিণত হলো।
Rue de Rivoli-র কর্মব্যস্ততার শব্দ বেড়ে উঠে একসময় তাও থেমে গেল। দূরে নটরডেম গীর্জায় মাঝরাতের ঘণ্টা বাজল। এখনও হলঘরের অন্ধকার কোণে স্মিথের ঘুমন্ত দেহটা এক নিঃসঙ্গ ছায়ামূর্তির মতো নিঃশব্দে বসে রইল।
.
রাত একটার দিকে মি. স্মিথের ঘুম ভাঙল। জেগে উঠে তিনি বড়ো করে শ্বাস নিলেন। এক মুহূর্তের জন্য ভাবলেন বাসায় স্টাডি রুমের চেয়ারে বসে পড়তে পড়তে বুঝি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। পর্দাবিহীন জানালা দিয়ে চাঁদের আলো পরিপূর্ণভাবে ঘরে ঢুকছে। সেই আলোয় সারি সারি মমি আর পালিশ করা বাক্স দেখে পরিষ্কার বুঝতে পারলেন তিনি কোথায় আছেন। কীভাবে এখানে রয়ে গেলেন তা বুঝতেও দেরি হলো না।
তবে মি. স্মিথ আতঙ্কিত হলেন না। নতুন পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিয়ে সে পরিবেশকে ভালোবাসা তার বংশের বৈশিষ্ট্য। তিনিও তার ব্যতিক্রম নন। হাত পায়ের খিল ভাঙাবার জন্য ছড়িয়ে বসে ঘড়ির দিকে তাকালেন। চাঁদের আলোয় সময় দেখে মুচকি হাসলেন। ভাবলেন, এই ঘটনা তার পরবর্তী গবেষণা বইয়ের জন্য একটি ছোটো অথচ চমৎকার কাহিনি হবে। কাটখোট্টা বিষয় পড়তে পড়তে পাঠক কিছুটা স্বস্তি পাবে।
একটু ঠান্ডা লাগছে। তবে স্মিথ পুরোপুরি জেগে আছেন। এখন বুঝতে পারছেন গার্ডরা কেন তাঁকে দেখতে পায়নি। যে দরজার আড়ালে তিনি ছিলেন সেটার কালো ছায়ায় তিনি পুরোপুরি ঢাকা পড়ে গিয়েছিলেন।
চারদিকে এই সুনসান নিস্তব্ধতা ভারি চমৎকার। বাইরে বা ভেতরে কোথাও একটু শব্দ, এমনকী একটু মর্মর ধ্বনি পর্যন্ত নেই। এক মৃত সভ্যতার মৃত মানুষদের সাথে তিনি একা রয়েছেন। এই ঘরের বাইরে রয়েছে উনবিংশ শতাব্দীর ভাপসা আবহাওয়া, কিন্তু তাতে কী! এ হলঘরে যে সব প্রাচীন বস্তু রয়েছে–গমের শুকনো মঞ্জুরী থেকে চিত্রশিল্পীর রঙের বাক্স পর্যন্ত-সবগুলো সুদীর্ঘ চার হাজার বছর ধরে মহাকালের সাথে লড়াই করে আজও টিকে রয়েছে। সুদূর অতীতের সাম্রাজ্য থেকে সময়ের স্রোতে ভেসে আসা কত জিনিস এখানে আছে। থিবিস, লুক্সর (Luxor) এমনকী হেলিও পোলিশের বিশাল মন্দিরগুলোর ধ্বংসাবশেষ থেকে বিভিন্ন নিদর্শন এখানে এসেছে। তা ছাড়া কয়েকশো সমাধি খনন করে সংগ্রহ করা বিপুল প্রাচীন দ্রব্য এখানে আনা হয়েছে।
স্মিথ নিস্তব্ধ মূর্তিগুলোর দিকে তাকালেন। আলো আঁধারিতে দেখে মনে হচ্ছে মূর্তিগুলো কাঁপছে। একদা ব্যস্ত, কঠোর পরিশ্রমী মানুষগুলো এখন চির বিশ্রামে শায়িত আছে। এসব ভাবতে ভাবতে স্মিথের মনটা যেন কেমন হয়ে গেল। নিজের যৌবন আর তুচ্ছতা সম্পর্কে এক ভিন্ন ধারণা যেন পেয়ে বসল তাঁকে। চেয়ারের পিঠে হেলান দিয়ে স্বপ্নীল দৃষ্টিতে সংগ্রহশালার দিকে তাকালেন। চাঁদের আলোতে সব কিছু যেন রুপালি হয়ে উঠেছে। সংগ্রহগুলোর মাঝখানে দর্শক চলাচলের সরু পথটা বিরাট হলের শেষ প্রান্তে চলে গেছে।