মিশরতত্ত্ব স্মিথকে এমনভাবে আকৃষ্ট করেছিল যে তিনি এক তরুণী মিশরতাত্ত্বিককে বিয়ে করে ফেললেন। এই তরুণী প্রাচীন মিশরের ষষ্ঠ রাজ বংশের ওপর মূল্যবান গবেষণা করেছিল।
গবেষণার ভিত্তি শক্ত তৈরি করে, মিস্টার স্মিথ গবেষণার উপাদান সংগ্রহ করতে আরম্ভ করলেন। তাঁর উদ্দেশ্য প্রাচীন মিশর নিয়ে এমন কাজ করবেন যার মধ্যে সংযুক্ত হবে Lepious-এর গবেষণা আর Champolion-এর উদ্ভাবনী দক্ষতা। আর এই বিরাট ঐতিহাসিক কাজের জন্য স্মিথকে প্রায়ই ফ্রান্সে যেতে হতো। সেখানকার স্যুভর জাদুঘরের প্রাচীন মিশরীয় সংগ্রহ খুবই সমৃদ্ধ। গত অক্টোবরের মাঝামাঝিতে তিনি শেষবার ভরে গিয়েছিলেন। সে সময় অদ্ভুত এক রহস্যময় ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
ট্রেনটা অনেক আস্তে চলছিল। আর ইংলিশ চ্যানেলের অবস্থাও ছিল খারাপ। তাই মি. স্মিথ প্যারিসে পৌঁছালেন কিছুটা বিভ্রান্ত এবং উত্তেজিত অবস্থায়। প্যারিসে পৌঁছে তিনি উঠলেন Rue Laffitte রাস্তার হোটেল দ্য ফ্রান্স-এ। হোটেল রুমে ঢুকে তিনি ক্লান্ত দেহটাকে সোফায় এলিয়ে দিলেন। কিন্তু ঘণ্টা দুয়েক শুয়ে থেকেও ঘুম এল না। তাই স্মিথ সিদ্ধান্ত নিলেন এখনই ল্যুভর মিউজিয়ামের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়বেন। যে কারণে তিনি মিউজিয়ামে যাবেন তাতে বেশি সময় লাগবে না। কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ হলে, সন্ধ্যার ট্রেনেই তিনি দিয়েঞ্জীতে (Dieppe) ফিরে যাবেন।
এই সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি সোফা ছেড়ে উঠে ওভারকোট গায়ে দিলেন। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। Boulevard des Italiens এবং Avenue de POPera পার হয়ে তিনি ভরে পৌঁছালেন।
ভর তাঁর খুব পরিচিত জায়গা। মিউজিয়ামে পৌঁছেই তিনি যে ঘরে প্যাপিরাসের সংগ্রহ রয়েছে সেদিকে পা চালালেন।
জন ভ্যান্সিটার্ট স্মিথকে খুব একটা সুদর্শন বলা যাবে না। তবে তাঁর টিয়া পাখির ঠোঁটের মতো নাক আর দৃঢ় চিবুক তাকে আর দশজন মানুষ থেকে স্বতন্ত্র করে রেখেছে। দেহের ওপর মাথাটাকে তিনি পাখির কায়দায় ধরে রেখেছেন। আলাপ আলোচনা করার সময় তিনি পাখির ঠোকরানোর মতো ভঙ্গি করেন। আর এভাবেই কোনো বিষয়ে আপত্তি জানান, কারও কথার জবাব দেন।
প্যাপিরাসের সংগ্রহশালায় স্মিথ ঢুকলেন। তাঁর ওভারকোটের কলার উঁচু করে কান পর্যন্ত তোলা। সামনের ডিসপ্লে কেসের কাছে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে ভাবলেন, সত্যিই তিনি অন্যরকম। কিন্তু পেছন থেকে ইংরেজি ভাষায় পরিষ্কার করে বলা কথাগুলো শুনে তিনি খুব কষ্ট পেলেন। পেছন থেকে তীক্ষ্ণ গলায় কেউ বলল, লোকটা দেখতে কী অদ্ভুত!
স্মিথের একটু বেশি পরিমাণেই অহমিকা বোধ আছে। পেছন থেকে মন্তব্য শুনে তার ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসল। তিনি কঠিন দৃষ্টিতে প্যাপিরাসের বান্ডিলগুলোর দিকে তাকালেন। সমস্ত ব্রিটিশ ভ্রমণকারীদের প্রতি বিতৃষ্ণায় তাঁর মনটা তিক্ত হয়ে গেল।
হ্যাঁ, আরেকটা কণ্ঠ বলল, লোকটা সত্যিই অসাধারণ।
তুমি জানো, প্রথম বক্তা বলল, যে কেউই বিশ্বাস করবে মমির ব্যাপারে ক্রমাগত চিন্তা করতে থাকলে কোনো লোক নিজেই অর্ধেক মমি হয়ে যায়?
লোকটার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সে মিশরীয়, দ্বিতীয় বক্তা বলল।
জন স্মিথ ঘুরে দাঁড়ালেন। উদ্দেশ্য, তার দেশের লোক দুটিকে কড়া কথা বলবেন। কিন্তু তিনি অবাক হয়ে গেলেন। পাশাপাশি স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন। দেখলেন লোকদুটো তাকে নিয়ে মন্তব্য করছে না। বরং তারা তার দিকে পেছন ফিরে লুভর মিউজিয়ামের এক বুড়ো অ্যাটেনডেন্টের দিকে তাকিয়ে আছে। অ্যাটেনডেন্ট রুমের অপর প্রান্তে বসে পিতলের তৈরি একটা জিনিস পালিশ করছিল।
কার্টার আমাদের জন্য প্যালেস রয়েল-এ অপেক্ষা করবে, একজন অপরজনকে বলল, ঘড়ির দিকে তাকাল। তারা চলে গেল। রুমের মধ্যে শুধু মাত্র মি. জন স্মিথ আর অপর প্রান্তে সেই অ্যাটেনডেন্ট।
বুঝলাম না ওরা কেননা বলল লোকটা দেখতে মিশরীয়দের মতে, স্মিথ ভাবতে লাগলেন। যে জায়গায় তিনি দাঁড়িয়ে আছেন সেখান থেকে লোকটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তাই স্মিথ একটু সরে দাঁড়ালেন। অ্যাটেনডেন্টের দিকে তাকিয়ে তিনি চমকে উঠলেন। মিশর নিয়ে গবেষণা করার সময় এধরনের চেহারার সাথে তাঁর পরিচয় হয়েছে।
লোকটার আকৃতি পাথুরে মূর্তির মতো, কপাল চওড়া, গায়ের রং ঈষৎ কালচে। এরকম চেহারার অসংখ্য পাথরের মূর্তি, মমি কেস আর ছবি এই বিশাল রুমের দেয়ালগুলোতে সাজানো রয়েছে।
ঘটনাটা কাকতালীয় বলা যায় না। লোকটা অবশ্যই মিশরীয়। তার কাঁধের কৌণিক গড়ন এবং সরু নিতম্ব তাকে মিশরীয় হিসেবে পরিচিত করে।
অ্যাটেনডেন্টের দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলেন স্মিথ। উদ্দেশ্য লোকটার সাথে কথা বলা। মানুষের সাথে কথা বলতে তিনি কখনো দ্বিধা বোধ করেন না। কিন্তু এবারে একটু অপ্রস্তুত বোধ করছেন। কাছে এসে তিনি অ্যাটেনডেন্টের মুখের এক পাশ দেখতে পেলেন। কারণ এখনও সে একমনে পালিশ করে যাচ্ছে। স্মিথ স্থির দৃষ্টিতে লোকটার গায়ের চামড়ার রং দেখতে লাগলেন। হঠাৎ তাঁর মনে হলো ওই চামড়ার মাঝে কেমন যেন এক অমানবীয় এবং অতিপ্রাকৃত ভাব রয়েছে। কপাল আর দুচোয়ালের চামড়া এমন চকচকে যেন বার্নিশ করা পার্চমেন্ট। কোনো লোমকূপের চিহ্নও নেই। এই শুষ্ক চামড়ায় একবিন্দু ঘামের কল্পনাও কেউ করতে পারবে না। কপাল থেকে চিবুক পর্যন্ত মুখের বাকি অংশ অসংখ্য সূক্ষ্ম বলি রেখায় ভরা। দেখে মনে হয় প্রকৃতি যেন মাউরি (Maori-নিউজিল্যান্ডের অধিবাসী) মেজাজে ওই মুখের ওপর পরীক্ষা করে দেখেছে যে কত জটিল নকশা সৃষ্টি করতে পারে সে।