ছেলেটি মন্দিরের বিশাল, কারুকাজ করা পুরু কাঠের দরজার সামনে দাঁড়াল। আঙুলের গাঁট দিয়ে টুক টুক শব্দ করল। কেউ সাড়া দিল না। আবার নক্ করল সে। জবাব নেই। মন্দিরের সবাই এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ল নাকি! অবাক হয় ছেলেটি। একটু ইতস্তত করে দরজায় ধাক্কা দিল সে। ক্যাআআচ শব্দে মেলে গেল কপাট। ভেতরে ঢুকল ছেলেটি। মাটির একটি প্রদীপ জ্বলছে কেবল। কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
ছেলেটি ভাবল কেউ না কেউ নিশ্চয় আসবে। সে মেঝেতে বসে পড়ল। অপেক্ষা করছে। ছেলেটি লক্ষ করল মন্দিরের সব কিছুই ধুলোয় ধূসর হয়ে আছে। মাকড়সার জালে ছেয়ে গেছে প্রায় পুরোটা জায়গা। বোঝাই যায় অনেক দিন ঝাঁটা পড়েনি। হয়তো ঝাঁটা দেয়ার লোক নেই। ছেলেটি মনে মনে আশান্বিত হয়ে উঠল তাকে ঠাকুর মশাই শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করবেন ভেবে। কারণ ঘর ঝাঁট দেয়ার জন্য হলেও তো ওদের একজন লোক লাগবে।
জানালায় বড়ো বড়ো পর্দা ঝুলতে দেখে খুশি হয়ে গেল ছেলেটি। বাহ, ছবি আঁকার চমৎকার ক্যানভাস পাওয়া গেছে। রঙ পেন্সিলের বাক্স সে সঙ্গেই নিয়ে এসেছে। দ্বিরুক্তি না করে বেড়ালের ছবি আঁকতে বসে গেল।
পর্দাগুলো ভরে ফেলল সে বড়ো বড়ো বেড়ালের ছবিতে। পথ চলার ক্লান্তিতে তার ঘুম এসে গেল। সে পুঁটুলি খুলে চাদর বিছিয়ে মেঝেতেই শুয়ে পড়ার তোড়জোর করছিল, এমন সময় মনে পড়ে গেল ধর্মগুরুর কথা–রাতের বেলা বড়ো জায়গা এড়িয়ে চলবে; ঘুমাবে ছোটো জায়গায়!
মন্দিরটি প্রকান্ড; আর সে একা। গুরুর কথাগুলো মনে পড়তে, অর্থ না। বুঝলেও, এবার তার কেমন ভয় ভয় করতে লাগল। সে ঘুমাবার জন্য ছোটো ঘর খুঁজতে লাগল। ক্ষুদ্র একটি কুঠুরিও পেয়ে গেল। কুঠুরির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। তারপর ছিটকিনি লাগিয়ে শুয়ে পড়ল মেঝেতে। একটু পরেই ঘুমিয়ে গেল।
গভীর রাতে ভয়ঙ্কর একটা শব্দে জেগে গেল সে। মারামারি করছে কারা যেন। ফ্যাঁচফ্যাঁচ, অপার্থিব আওয়াজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জান্তব চিৎকার। এমন ভয় পেল ছেলেটি, দরজার ফাঁক দিয়েও মন্দিরের ভেতরে তাকাতে সাহস পেল না। তার কেবলই মনে হচ্ছিল তাকালেই এমন ভয়াবহ কিছু একটা সে দেখবে যে হার্টফেল হয়ে যাবে। সে মেঝেতে গুটিসুটি মেরে পড়ে রইল। নিশ্বাস নিতেও ভুলে গেছে।
আলোর যে সূক্ষ্ম রেখা ঢুকছিল দরজার ছিলকা দিয়ে তা হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল। ছেলেটি বুঝতে পারল নিভে গেছে মন্দিরের বাতি। নিকষ আঁধারে ডুবে গেল ঘর। তবে ভীতিকর শব্দগুলো চলল বিরতিহীন। ফোঁস ফোঁস নিশ্বাসের আওয়াজ, রক্ত হিম করা গলায় কে যেন আর্তনাদ করে উঠছে মাঝে মঝে। গোটা মন্দির থরথর করে কাঁপছে। বোঝা যাচ্ছে দরজার বাইরে মরণপণ লড়াইয়ে মেতে উঠেছে দুটি পক্ষ। অনেকক্ষণ পরে নেমে এল নীরবতা। কিন্তু ছেলেটি ভয়ে নড়ল না এক চুল। অবশেষে ভোর হলো। সোনালি আলো দরজার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ল ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে।
লুকানো জায়গা থেকে খুব সাবধানে বেরিয়ে এল ছেলেটি। তাকাল চারদিকে। দেখল মন্দিরের মেঝেতে রক্ত আর রক্ত! রক্তের পুকুরের মাঝখানে মরে পড়ে আছে গরুর চেয়েও আকারে বড়ো একটি দৈত্যকার ইঁদুর। মন্দিরের পিশাচ!
কিন্তু এটাকে হত্যা করল কে? মানুষজন কিংবা অন্য কোনও প্রাণী দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ ছেলেটি লক্ষ করল সে গতরাতে পর্দায় যে সব বেড়ালের ছবি এঁকেছে, সবগুলো বেড়ালের গায়ে রক্ত মাখা! সে তক্ষুনি বুঝতে পারল পিশাচ ইঁদুরটাকে তারই আঁকা বেড়ালরা হত্যা করেছে। এবং এখন সে বুঝতে পারল বৃদ্ধ পুরোহিতের সেই সাবধান বাণীর মানে-রাতের বেলা বড়ো জায়গা এড়িয়ে চলবে; ঘুমাবে ছোটো জায়গায়।
ওই ছেলেটি বড় হয়ে খুব বিখ্যাত চিত্রকর হয়েছিল। আর তার আঁকা বেড়ালের সেই ছবিগুলো এখনও ওই মন্দিরে আছে!
ভুতুড়ে আংটি
মিস্টার জন ভ্যান্সিটার্ট স্মিথ, এফ.আর.এস, থাকেন ১৪৭ গাউয়ার স্ট্রিটে। তিনি এমন একজন মানুষ যাঁর চিন্তার স্বচ্ছতা আর কর্মশক্তি তাঁকে প্রথম সারির বৈজ্ঞানিকদের দলে স্থান করে দিতে পারত। কিন্তু তিনি বিশ্বজনীন উচ্চাকাঙ্খর শিকারে পরিণত হয়েছিলেন। ফলে কোনো এক বিষয়ে সেরা হওয়ার চাইতে নানা বিষয়ে বৈশিষ্ট্য অর্জন করার দিকেই তাঁর ঝোঁক ছিল।
প্রথম দিকে প্রাণিবিদ্যা আর উদ্ভিদ বিদ্যার দিকে তাঁর প্রচণ্ড ঝোঁক ছিল। এই দুই বিষয়ে তিনি এমন ভাবে কাজ করেছিলেন যে তাঁর বন্ধুরা তাঁকে দ্বিতীয় ডারউইন ভাবতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু যখন একটি অধ্যাপকের পদ প্রায় তার নাগালের মধ্যে এসে গিয়েছে, তখনই তিনি এসব বিষয়ে পড়াশোনা বন্ধ করে রসায়ন শাস্ত্রের ওপর সম্পূর্ণ মনোযোগ দেন। এখানে তিনি ধাতুর বর্ণালীর ওপর গবেষণা করে রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ অর্জন করেন।
কিন্তু এবারও তিনি একই কাজ করলেন। ল্যাবরেটরিতে এক বছর অনুপস্থিত থাকার পর মি. স্মিথ ওরিয়েন্টাল সোসাইটিতে যোগ দেন। এলকাব-এর হায়ারোগ্লিফিক এবং ডিমোটিক লিপি সম্পর্কে একটি মূল্যবান গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন। আর এভাবেই মি. স্মিথ একদিকে যেমন বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় দিলেন, অন্যদিকে তেমনি দেখালেন তাঁর প্রতিভার অস্থিরতা।
এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ এক সময় না এক সময় কিছু একটায় থিতু হয়। মি. স্মিথও তার ব্যতিক্রম নন। প্রাচীন মিশরতত্ত্ব মানে ঈজিপ্টোলজির যত গভীরে তিনি প্রবেশ করতে লাগলেন ততই তিনি অভিভূত হয়ে পড়লেন। তাঁর কাছে জ্ঞানের এক নতুন দিগন্ত খুলে গেল। মানব সভ্যতার সূচনা যেখানে হয়েছিল তার ওপর গবেষণার মাধ্যমে নতুন কিছু আবিষ্কারের কী বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে তা তিনি সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছিলেন।