চলুন, ক্যাপ্টেন, আমরা খাবার ঘরে বসে আরেকটু কথা-টথা বলি।
গ্লাসে নতুন করে মদ ঢেলে মুখোমুখি বসলাম আমরা।
সারা বছরই আমাদের দুজনের এই একলা পালা চলে আসছে, বললেন ডাক্তার। ওর শেষ হলেই ধরবে আমাকে। তবে ভাগ্য ভালো যে এক সঙ্গে দুজনে কখনও পড়িনি। আজ রাতে বেচারাকে একাই থাকতে হবে। খুবই খারাপ লাগছে। কিন্তু কোনো উপায় নেই, আজ ভয়ঙ্কর এক রহস্যের সমাধান আমাকে করতেই হবে। ওই কারখানাঘরে বসে রাত জেগে পাহারা দেব। আজ আমাকে জানতেই হবে, কুলিদের মনে কেন এত ভয়? কেন তারা সূর্য ডোবার সাথে সাথে দ্বীপ ছেড়ে পালায়।
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে আমি শুনতে থাকলাম ডাক্তারের কথা। তিনি বললেন, পিপেটিপে যাতে চুরি না হয়, তাই কারখানা পাহারা দেয়া হয়। আজ থেকে ছয় দিন আগে একজন আফ্রিকান রাতে পাহারায় ছিল। সকালে আর তার কোনো চিহ্নই দেখা গেল না। অনেক খোঁজাখুঁজি করা হল। কোন শালতি কিংবা ডিঙিও খোয়া যায়নি যে ভাবব সে পালিয়েছে। আর পালানোর চেষ্টা করা তো আত্মহত্যার সামিল। কারণ কুমিরে গিজগিজ করছে নদী। জলজ্যান্ত মানুষটি যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। এ-ঘটনার ঠিক তিন দিন পর অর্থাৎ আজ থেকে তিনদিন আগে আবারও একজন গার্ড গায়েব হয়ে গেল। সেই একই অবস্থা। কোন পাত্তা নেই। ওয়ালকার আর আমি এই ঘটনাটা যেভাবেই দেখি না কেন, স্থানীয় কর্মচারীরা প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেছে। ওদের ধারণা, এটা কোন ভূতুড়ে ব্যাপার।
তা কী করে সম্ভব? বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
সেটাই তো রহস্য। কোন যুক্তিই খুঁজে পাচ্ছি না। সবারই বিশ্বাস, দৈত্য-দানবের কাজ। তিনদিন পরপর তার জ্যান্ত মানুষ প্রয়োজন। এটা মাথায় ঢোকার পর থেকে আর কোনমতেই ওরা দ্বীপে থাকতে রাজি নয়। এই মাউসা ছেলেটার কথাই ধরুন, খুবই বিশ্বাসী আর অনুগত। দেখলেনই তো, সেও কোনমতেই রাজি হলো না। ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই মুশকিল হয়ে উঠেছে। এ রহস্যের সমাধান তাই করতেই হবে আমাকে। আজকে এসেছে সুযোগ। আরেকটা তৃতীয় রাত। নিজেই আজ টোপ হতে যাচ্ছি। তাছাড়া আর তো কোন উপায় দেখি না।
কোনো সূত্রও কি পাননি? যেমন–ধস্তাধস্তি, পায়ের দাগ অথবা রক্ত টক্ত?
নাহ! কিছু পাইনি।
আশ্চর্য! যা বুঝলাম, আপনার একার জন্য খুব কঠিন হবে। আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি!
সত্যি করবেন? উফ্, বাঁচালেন! ডাক্তার যেন পরম স্বস্তি পেলেন।
যাই, জাহাজে গিয়ে জানিয়ে আসি, আজ রাতে আমি দ্বীপেই থাকব।
চলুন, আমিও আপনার সাথে যাই।
ফেরার পথেই পশ্চিম আকাশে ঘনিয়ে এল ঘন কালো মেঘ। এলোমলো ঝড়ো হাওয়া শুরু হলো। প্রচণ্ড গর্জনে ঢেউ এসে আছড়ে পড়তে লাগল সৈকতে। থেকে থেকে গরম বাতাসের ঝাঁপটা মারতে লাগল মুখে।
ঝড়ের গতি দেখে তো ভালো মনে হচ্ছে না, বিড়বিড় করে বললেন ডাক্তার।
কেন? অবাক হলাম আমি।
যে গরম বাতাস, বোঝাই যাচ্ছে নদীর ওপারের জঙ্গলে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। ওই বৃষ্টির পানিতে ঢল নামবে নদীতে। তার ওপর আসছে জোয়ার। এমন পরিস্থিতিতে সমুদ্র যেভাবে ফুঁসে ওঠে, মনে হয়, ভাসিয়ে নিয়ে যাবে বুঝি দ্বীপটা।
কারখানায় যাওয়ার আগে ওয়ালকারকে দেখে আসি।
গাঢ় ঘুমে মরার মতো পড়ে আছে ওয়ালকার। তার খাটের পাশের টেবিলে এক গ্লাস লেবুর শরবত করে রাখলেন ডাক্তার। বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে কারখানার পথ ধরলাম। কারখানায় পৌঁছে লণ্ঠন জ্বাললেন ডাক্তার। তারপর সলজ্জ হেসে বললেন, বই, তামাক সবই আছে। খুব একটা অসুবিধে হবে না।
লণ্ঠনের আলোয় এতবড় ঘরটা আলোকিত হলো না, বরং কেমন যেন বিষণ্ণ আর স্নান মনে হলো। পাশাপাশি চেয়ার পেতে রাত জাগার জন্যে প্রস্তুত হলাম আমরা। আমার জন্য একটা রিভলভার আর নিজের জন্য একটা শক্তিশালী দোনালা বন্দুক বের করে টেবিলের ওপর রাখলেন ডাক্তার। যাতে দরকার পড়লেই দ্রুত ব্যবহার করা যায় ওগুলো।
দেয়ালে কালো বড়ো বড়ো দুই ছায়া পড়েছে আমাদের দুজনের। হালকা আলোয় ভৌতিক মনে হচ্ছে। আলো এত কম! শিরশির করে উঠল গা। ডাক্তারও বোধহয় ভয় পাচ্ছিলেন, তাই উঠে গিয়ে আরো দুটি মোমবাতি জ্বাললেন। আমার চেয়ে তিনি অনেক বেশি সাহসী। কোনো সন্দেহ নেই। তবু তার মধ্যে অস্থিরতা লক্ষ্য করলাম। একটা বই খুলে পড়তে বসলেন। কিন্তু এক পাতাও পড়তে পারলেন না। অস্থিরভাবে তিনি বারবার তাকাতে লাগলেন এদিন-সেদিক। কাঠ হয়ে বসে আছি। ভয়াবহ নিস্তব্ধতা যেন দুঃস্বপ্নের মতো চেপে বসে আছে আমার বুকের ওপর। অশুভ রহস্যটা কল্পনার নানান রঙে রাঙিয়ে ভীত-বিহ্বল করে তুলল আমাকে। যেন মৃত্যুদূতের প্রতীক্ষায় অনন্তকাল বসে আছি দুজনে। কেমন তার চেহারা, কীভাবে সে আসবে কিছুই জানি না। শুধু অপেক্ষা আর অপেক্ষা।
ডাক্তারকে দুঃসাহসী মনে হলো। কী সাংঘাতিক! তিনি একাই থাকতে চেয়েছিলেন এই ঘরে! ওরে বাপরে, পৃথিবীর সমস্ত ধন-সম্পদের বিনিময়েও এই ঘরে আমি একা রাত কাটাতে রাজি হতাম না।
অনন্ত যেন এই ভয়াবহ রাত। পানির স্রোতের ক্রুদ্ধ গর্জন। খ্যাপা হাওয়ার শোঁ-শোঁ শব্দ। ঝপাৎ ঝপাৎ করে ভেঙে পড়ছে মাটির চাই। একনাগাড়ে ডেকে যাচ্ছে ঝিঁঝি পোকা। এত বিকট শব্দের মাঝে বসে আছি তবু মনে হচ্ছে নিদারুণ নিস্তব্ধ সব। হঠাৎ ডাক্তারের হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল বইটা। আমার হৃৎপিণ্ডের শব্দ যেন থেমে গেল। সমস্ত রক্তস্রোত ছলকে উঠল বুকের মধ্যে।