কী গাছ ওগুলো? জিজ্ঞেস করলাম।
অনেক রকমের গাছ আছে। সেগুনই বেশি। এই যে এসে গেছি।
তাকাতেই দেখি সামনে সাদা ঘরটা। কথা বলতে বলতে কখন যে ফিরে এসেছি লক্ষ্যই করিনি।
এটাই আমাদের পিপে তৈরির কারখানা, একটু ইতস্তত করে রহস্যময় কণ্ঠে বললেন তিনি। আচ্ছা এই ঘরটা দেখে কি কিছু মনে হচ্ছে আপনার? এই, মানে–অশুভ কিছু?
ঝট করে ঘরটার দিকে তাকালাম। সাদা রঙ করা কাঠের বেড়া। উঁচু টিনের চালা আর মাটি দিয়ে সুন্দর করে লেপা মেঝে। ঘরের এক কোণে মেঝেতে মাদুর পেতে কম্বল বিছিয়ে বিছানা করা। পাশে একটা টেবিল আর দুটো চেয়ার ছাড়া পুরো ঘরটাই খালি। বললাম, কই নাতো। তেমন কিছু তো মনে হচ্ছে না।
হ্যাঁ, আর দশটা ঘরের মতো খুবই সাধারণ দেখতে এই ঘরটা; কিন্তু তবু অসাধারণ। আজ আমি একা এই ঘরে থাকব। ওই বিছানায় ঘুমাব। ভাবতেই ভয় লাগছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি ভীতু নই।
এমন করে বলছেন কেন? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
কিছুদিন ধরে এখানটাতে অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটছে। আপনি ভেবেছেন এখানকার জীবন একঘেয়ে। কিছুদিন দ্বীপটায় কাটালেই বুঝতে পারবেন, উত্তেজনা আর রহস্যের কোন অন্ত নেই এখানে। সূর্য ডোবার সাথে সাথে আজব কুয়াশায় ঢেকে যায় পুরো দ্বীপ। এখানকার লোকে একে বলে জ্বর কুয়াশা। নদীর ওপারের জলাটা দেখুন।
ছোটো ছোটো ঘন ঝোঁপ-ঝাড় থেকে উঠে আসছে চাপ চাপ বাস্প; চওড়া নদী পেরিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে, দ্বীপের দিকে। বাতাস অনেক বেশি ঠান্ডা আর স্যাঁতসেঁতে।
চলুন, রাতের খাবারের ঘণ্টা পড়েছে। আর হ্যাঁ, এই ঘরটা সম্পর্কে আগ্রহ থাকলে পরে নাহয় শুনবেন।
আগ্রহ বলছেন কী? আমি তো শোনার জন্য রীতিমতো অস্থির হয়ে উঠেছি।
মৃদু হেসে মাথা নাড়লেন তিনি। খালি ঘরটার দিকে ওঁর মগ্ন হয়ে তাকিয়ে থাকা, রাত কাটানোর কথাতে তাঁর ভয় আর সতর্কতার অভিব্যক্তি আমাকে প্রচণ্ড আগ্রহী করে তুলেছে।
কিছু মনে না করলে আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতাম, বললাম আমি।
বলুন না।
শ্রমিকদের থাকার যে কুঁড়েঘরগুলো দেখালেন, সেখানে যে কাউকে দেখলাম না?
ওরা রাতে ঘুমানোর জন্য ওই জাহাজটায় চলে গেছে।
তাকিয়ে দেখি নদীর পারের খাড়িতে একটা ভাঙা জাহাজ পড়ে রয়েছে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ওই ভাঙা জাহাজে থাকে? কেন? তাহলে ওদের থাকার জন্য এই কুঁড়েগুলো বানানোর দরকার কি ছিল?
কয়েকদিন আগেও ওরা এখানেই থাকত। প্রাণের ভয়ে এখন আর থাকে না। রাতে এই দ্বীপে এখন ওয়ালকার আর আমি ছাড়া কেউ থাকে না।
কিসের ভয়?
চলুন খেতে যাই। খাওয়া-দাওয়ার পর সবই বলব আপনাকে।
খাবার আয়োজনটা বেশ যত্ন সহকারেই করা হয়েছে। বন তিতিরের ঝাল মাংস আর লাল আলুর চাটনি। বেশ সুস্বাদু। খাবার পরিবেশন করল সিয়েরালিয়েনের একটি ছেলে। এ ছেলেটি ভয়ে আর সবার মতো পালায়নি দেখে অবাকই হলাম। খাওয়া শেষ হলো। মদ ঢেলে দিল সে। তারপর নিজের মাথার পাগড়িটা ঠিক করে বিনীত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, স্যার, আপনাদের কি আর কিছু লাগবে?
না মাউসা, আমাদের আর কিছুই লাগবে না, বললেন ওয়ালকার। আমার শরীরটা ভালো না। আজ রাতটা কি তুমি আমার কাছে থাকবে?
মুহূর্তে ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেল ছেলেটির মুখ। না-না, স্যার! আমাকে মাপ করুন। ককিয়ে উঠল সে। আপনি বরং আমাদের জাহাজটাতে চলুন। সারারাত জেগে আপনার আমি সেবা করব।
ঠিক আছে, তুমি যাও। আর শোন, ভয় পেয়ে কর্তব্যে অবহেলা কোনো ইংরেজ করে না।
আজকে আমাকে মাপ করবেন, স্যার। গতকাল কিংবা আগামীকাল হলেও নাহয় কিছু একটা করতাম। কিন্তু আজ যে তৃতীয় দিন। আজ আমি কোন কিছুর বিনিময়েই এই দ্বীপে থাকতে পারব না।
কাঁধ ঝাঁকালেন ওয়ালকার। তুমি না থাকলে তো আর আমরা জোর করতে পারি না। তুমি রেডি থেকো, ফাস্ট মেল-বোট এলেই তোমাকে সিয়েরালিয়েনে চলে যেতে হবে। বিপদের সময় যাকে দিয়ে সামান্যতম উপকার হয় না, তেমন কর্মচারীর দরকার নেই আমাদের।
চাকরি যাওয়ার ভয় দেখিয়েও কোনো লাভ হলো না। কিছুতেই রাজি হলো না সে।
সমস্ত ব্যাপারটাই কেমন অদ্ভুত দেখলেন তো? আপনিই নিশ্চয়ই ডাক্তারের কাছ থেকে সব কিছু শুনেছেন?
না, ওয়ালকার। ওঁকে এখনও কিছুই বলিনি, বললেন ডাক্তার। পিপে তৈরির কারখানাটা শুধু দেখিয়েছি। কিন্তু তোমাকে দেখে তো মোটেও সুস্থ মনে হচ্ছে না। আবার জাঁকিয়ে জ্বর আসছে নাকি হে?
হ্যাঁ। সারাটা দিনই কেমন খারাপ লেগেছে। এখন মনে হচ্ছে মাথার মধ্যে যেন হাজারটা কামানের গোলা ফাটছে। প্রায় দশ গ্রাম কুইনিন খেয়েছি। কানের মধ্যেও ভোঁ ভোঁ করছে, ম্লান হেসে বললেন তিনি। তুমি চিন্তা কোরো না। অসুস্থ হলেও তোমার সঙ্গে কারখানায় থাকব আমি।
না-না, ওয়ালকার, বাধা দিলেন ডাক্তার। খারাপ শরীর নিয়ে তোমাকে ওখানে ঘুমোতে যেতে হবে না। তুমি বরং এখনই তোমার বিছানায় শুয়ে পড়। আমি একাই থাকব কারখানায়।
মি, ওয়ালকারের ফোলা ফোলা মুখ, টকটকে লাল চোখ আর অতিরিক্ত কাঁপুনিতে দাঁতে দাঁত বাড়ি খেতে দেখে বুঝলাম, এই সেই আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল অঞ্চলের ম্যালেরিয়া। যা অতর্কিত হামলা চালিয়ে একেবারে ধরাশায়ী করে ফেলে।
ডাক্তার আর আমি ওয়ালকারকে ধরাধরি করে শোবার ঘরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলাম। একটা কড়া ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে দিলেন ডাক্তার, যাতে রাতে ঘুম ভেঙে কষ্ট না পান।