অবস্থার বর্ণনা আগে যা দিয়েছিলাম, দেখা গেল তার রদবদল হয়নি-ভালডিমার রয়েছেন ঠিক একইভাবে। আয়না ধরলে নিশ্বাসের লক্ষণ আর ধরা পড়ছে না-তফাত শুধু এইখানে। বাহু থেকে রক্ত টেনে বার করার চেষ্টা ব্যর্থ হলো। আমার ইচ্ছাশক্তি দিয়ে বাহু আর নাড়াতেও পারছিলাম না। সম্মোহনের ভাব দেখা যাচ্ছিল কেবল ভালডিমারের জিভে। যতবার প্রশ্ন করেছি, ততবার জিভ থরথর করে কেঁপে উঠেছে, যেন আপ্রাণ চেষ্টা করছে জবাব দেওয়ার-কিন্তু স্বর ফুটছে না। আমি ছাড়া অন্যরা প্রশ্ন করে ব্যর্থ হয়েছেন, এমনকি যুগ্ম-সম্মোহনের প্রভাবেও অন্যকে দিয়ে প্রশ্ন করে ফল পাইনি-ভালডিমারের জিভ নিথর থেকেছে। অন্য নার্সদের জুটিয়ে এনে তাদের জিম্মায় ভালডিমারকে রেখে দশটার সময়ে ডাক্তার দুজন আর মি. এলকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম বাড়ি থেকে।
বিকেলের দিকে আবার সবাই এলাম রোগীকে দেখতে। অবস্থা আগের মতোই। আবার ওঁকে জাগানোর চেষ্টা কওে কোনো লাভ নেই, এ বিষয়ে একমত হলাম প্রত্যেকেই। পরিষ্কার দেখা গেল, মৃত্যু বলতে যা বোঝার সম্মোহনের প্রভাবে তাকে আটকে রাখা সম্ভব হয়েছে। এ অবস্থায় ওঁকে ফের জাগাতে গেলে মৃত্যু ত্বরান্বিত হবে।
সেদিন থেকে গত সপ্তাহ পর্যন্ত, ঝাড়া সাত মাস একইভাবে পড়ে থেকেছেন ভালডিমার। ডাক্তার এবং অন্যান্যদের নিয়ে দেখে এসেছি মাঝে মাঝে। নার্সদের তদবিরে ছেদ পড়েনি মুহূর্তের জন্যেও।
গত শুক্রবার ঠিক করলাম, আবার ওঁকে জাগানোর চেষ্টা করা যাক। সর্বশেষ এই এক্সপেরিমেন্টের ফল শুভ হয়নি এবং এ নিয়েই যত কিছু কানাঘুষার সূচনা ঘটেছিল আড়ালে আবডালে।
সম্মোহনী প্রক্রিয়ার বিধিমত হস্তচালনা করে বেশ কিছুক্ষণ বিফল হলাম। তারপর দেখা গেল কনীনিকা আস্তে আস্তে একটুখানি নামল নিচের দিকে। সেইসঙ্গে বিকট দুর্গন্ধময় হলদেটে রস বেরিয়ে এল নেমে আসা চোখের তারার আশপাশ দিয়ে।
চেষ্টা করলাম ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে ভালডিমারের বাহু আবার চালনা করা যায় কিনা। ব্যর্থ হলাম। ডক্টও এফ-এর ইচ্ছানুসারে তখন একটা প্রশ্ন করলাম :
মঁসিয়ে ভালডিমার, এই মুহূর্তে আপনার ইচ্ছে বা অনুভূতি কি ধরনের, বলতে পারবেন?
মুহূর্তের মধ্যে হনু দুটোর ওপর জ্বরতপ্ত চক্রাকার লোহিত আভা জেগে উঠল। থরথর করে কেঁপে উঠল জিভ-যেন ভীষণভাবে ঘুরপাক খেতে লাগল হাঁ করা মুখগহ্বরের মধ্যে। চোয়াল আর ঠোঁট আগের মতোই আড়ষ্ট ছিল বলে হাঁ হয়ে আছে মুখটা এই সাত মাস। তার পরেই, বেশ কিছুক্ষণ পরে, কদাকার সেই স্বর ঠিকরে ঠিকরে বেরিয়ে এল জিভ দিয়ে
ঈশ্বরের দোহাই! তাড়াতাড়ি করুন! তাড়াতাড়ি! হয়, ঘুম পাড়িয়ে দিন, না হয় জাগিয়ে দিন!–এক্ষুনি! এইমাত্র! আমি মারা গেছি!
ভীষণ ঘাবড়ে গেলাম। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। তারপর ভালডিমারকে সুস্থ করবার চেষ্টা করলাম। ব্যর্থ হলাম একেবারেই। চেষ্টা করলাম জাগাতে। ইচ্ছাশক্তি সংহত করে ধস্তাধস্তি করে গেলাম বললেই চলে। লক্ষ করলাম, কাজ হচ্ছে। ভালডিমারের সম্মোহনের প্রভাব কেটে যাবে এখুনি। ঘরসুদ্ধ লোক সাগ্রহে চেয়ে রইলেন কি হয় দেখবার জন্য।
যা হয়েছিল, তা এমনই অসম্ভব কাণ্ড যা দেখার জন্য প্রস্তুত থাকতে পারে না। কোনো মানুষ।
দ্রুত হাত চালিয়ে যাচ্ছি আর শুনছি বিকট বীভত্স হাহাকার-মারা গেছি! মারা গেছি! কথাটা বেরোচ্ছে কিন্তু ঘুরপাক খাওয়া জিভ থেকে, ঠোঁট থেকে নয়। তারপরেই আচমকা আমার হাতের নিচেই পুরো দেহটা এক মিনিটের মধ্যে কুঁচকে, গুটিয়ে ছোট্ট হয়ে খুঁড়িয়ে, একদম পচে গেল। বিছানাময় পড়ে রইল কেবল অতি জঘন্য এবং অত্যন্ত দুর্গন্ধময় খানিকটা জলীয় পদার্থ।