তখন মধ্যরাত্রি। ঘরে যারা ছিলেন, তাঁদেরকে বললাম ভালডিমারকে ভালোভাবে দেখে নিতে। প্রত্যেকেই একবাক্যে বললেন, উনি এখন পুরোপুরি সম্মোহিত। ডক্টর ডি অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে উঠলেন-সারা রাত থাকতে চাইলেন। ডক্টর এফ বলে গেলেন ভোর হলেই চলে আসবেন। মি. এল আর নার্স দুইজন রইলেন ঘরে।
রাত তিনটে পর্যন্ত ভালডিমারকে রেখে দিলাম একইভাবে। ডক্টর এফ বিদায় নেওয়ার সময়ে ওঁকে যেভাবে দেখে গিয়েছিলেন, তখনো হুবহু সেইভাবেই। নাকের সামনে আয়না ধরলে শুধু বোঝা যাচ্ছে নিশ্বাস পড়ছে। চোখ বন্ধ, হাত-পা মার্বেল পাথরের মতো শক্ত আর ঠান্ডা। কিন্তু মৃত্যুর লক্ষণ নেই শরীরের কোথাও। ভালডিমারকে এর আগে সম্মোহিত অবস্থায় রেখে একটা ব্যাপারে পুরোপুরি সফল হইনি কখনোই। ডান বাহুর ওপর হাত চালিয়ে ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে আমার হাত নাড়ার অনুকরণে তাঁর হাত নাড়াতে পারিনি! মৃতবৎ ভালডিমারের ক্ষেত্রে সেই চেষ্টা আবার করলাম-ব্যর্থ হব জেনেই করলাম। কিন্তু অবাক হয়ে গেলাম। আশ্চর্যভাবে সফল হওয়ায়। আমার হাত যেদিকে যেদিকে গেল, ওঁর হাতও নড়তে লাগল সেই দিকে।
জিজ্ঞেস করলাম, সিয়ে ভালডিমার, আপনি কি ঘুমোচ্ছেন? উনি জবাব দিলেন না। কিন্তু থিরথির করে কেঁপে উঠল ঠোঁটজোড়া। পরপর তিনবার জিজ্ঞেস করলাম একই প্রশ্ন। তৃতীয় বারে ওঁর চোখের পাতা খুলে গেল। শিথিলভাবে নড়ে উঠল ঠোঁট এবং দুঠোঁটের ফাঁক দিয়ে অতি অস্পষ্ট ফিসফিসানির মতো ভেসে এল
হ্যাঁ, ঘুমোচ্ছি। জাগাবেন না! মরতে দিন এইভাবেই!
হাত আর পা দেখলাম আগের মতোই শক্ত অথচ আমি হাত নাড়ালেই উনি ডানহাত একইভাবে নাড়াচ্ছেন।
প্রশ্ন করলাম, বুকে ব্যথা এখনো অনুভব করছেন?
জবাবটা এল তক্ষুনি, তবে আগের চাইতে আরও অস্পষ্টভাবে, কোনো ব্যথা নেই-আমি মারা যাচ্ছি!
ভোরের দিকে এফ না আসা পর্যন্ত ভালডিমারকে আর ঘাটালাম না। রোগী এখনো বেঁচে আছে দেখে উনি তো স্তম্ভিত। নাড়ি টিপে এবং ঠোঁটের কাছে আয়না ধরে পরখ করে নিয়ে আমাকে বললেন প্রশ্ন চালিয়ে যেতে।
আগের মতোই মিনিট কয়েক ভালডিমার কোনো জবাব দিলেন না। মনে হলো, শক্তি সঞ্চয় করছেন। পরপর চারবার একই প্রশ্ন করলাম। চতুর্থবারে অতি ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন
হ্যাঁ, এখনো ঘুমিয়ে আছি-মারা যাচ্ছি।
ডাক্তাররা বললেন, ভালডিমারের এই প্রশান্ত অবস্থাকে টিকিয়ে রাখা হোক মৃত্যু না আসা পর্যন্ত। মৃত্যুর নাকি আর দেরি নেই, বড়জোর আর কয়েক মিনিট।
আগের প্রশ্নটাই আবার জিজ্ঞাসা করলাম ভালডিমারকে।
সঙ্গে সঙ্গে আশ্চর্য পরিবর্তন দেখা গেল মুখাবয়বে। চক্ষুগোলক আস্তে আস্তে ঘুরে উঠে গেল ওপর দিকে, চোখের তারা অদৃশ্য হয়ে গেল সেই কারণেই; বিবর্ণ হয়ে গেল চামড়া-সাদা কাগজের মতো; দুই হনুর ওপর জ্বরভাবযুক্ত উত্তপ্ত চক্রাকার দাগ দুটো নিভে গেল আচমকা। নিভে গেল শব্দ দুটো ব্যবহার করলাম। বিশেষ কারণে। মনে হলো, ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেওয়া হলো জ্বলন্ত মোমবাতি। এতক্ষণ দাঁত ঢাকা ছিল ওপরের ঠোঁট ঝুলে থাকায় অকস্মাৎ কাঁপতে কাঁপতে ওপরের ঠোঁট ওপর দিকে গুটিয়ে যাওয়ায় প্রকট হলো দাঁতের সারি-ঝপাৎ করে নীচের চোয়াল ঝুলে পড়ায় বেরিয়ে পড়ল ফুটে ওঠা কালচে জিভ। ঘরে যারা উপস্থিত ছিলেন, মৃত্যু দেখে তাঁরা অভ্যস্ত। তা সত্ত্বেও ভালডিমারের ঐ ভয়ানক মুখচ্ছবি দেখে সভয়ে সিঁটিয়ে খাটের পাশে পেছিয়ে গেলেন প্রত্যেকেই।
জানি পাঠকের মনে অবিশ্বাস দানা বাঁধছে। তা সত্ত্বেও যা ঘটেছিল, হুবহু তা বলে যাব।
ভালডিমারের সারা অঙ্গে প্রাণের আর কোনো লক্ষণ না দেখে আমরা ধরে নিলাম উনি মারা গেছেন। নার্সদের তদবিরের ওপরে তাকে ছেড়ে দেওয়াই ঠিক করলাম সবার মত নিয়ে। ঠিক তক্ষুনি ভীষণভাবে কেঁপে উঠল তার জিভ। কাঁপতে লাগল পুরো এক মিনিট ধরে। তারপর হাঁ হয়ে থাকা নিথর চোয়ালের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল এমন ভয়ানক এক কণ্ঠস্বর যার বর্ণনা দেওয়া আমার পক্ষে বাতুলতা। শব্দটা কর্কশ, ভাঙা ভাঙা এবং শূন্যগর্ভ। বীভৎস। মানুষের কান কখনো এরকম বিকট শব্দ শোনেনি। দুটো কারণে তা অপার্থিব-অন্তত আমার তাই মনে হয়েছিল। প্রথম, শব্দটা যেন ভেসে এল বহুদূর থেকে, পাতাল থেকে। দ্বিতীয়টি, আঠালো বস্তুর মতো চটচটে ছিল ওই শব্দ।
শব্দ আর কণ্ঠস্বর-এর কথাই কেবল বললাম। আরও একটু খুলে বলা যাক। আওয়াজটা আশ্চর্য রকমের রোমাঞ্চকর স্পষ্ট শব্দাংশ। মিনিট কয়েক আগে ভালডিমারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, উনি এখনো ঘুমাচ্ছেন কিনা। উনি তার জবাব দিলেন এইভাবে
হ্যাঁ;–না-ঘুমিয়েছিলাম-এখন-এখন মারা গেছি।
গায়ের লোম খাড়া হয়ে গিয়েছিল শব্দটার বীভৎস উচ্চারণে; শব্দ যে এরকম লোমহর্ষকভাবে উচ্চারিত হতে পারে, এরকম থেমে থেমে মেপে মেপে জিভ দিয়ে বেরোতে পারে-অতি বড় দুঃস্বপ্নেও কেউ তা কল্পনা করতে পারবেন না। সুতরাং, গায়ে কাঁটা যে দিয়েছিল তা অস্বীকার করার জো নেই। এক কথায় শব্দটা উচ্চারিত হওয়ার মতো নয় একেবারেই-কিন্তু তবুও তা ভয়াল অনুকম্পন তুলে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে ঠিকরে এসেছিল জিভ দিয়ে যেন কবরের অন্ধকার থেকে। মেডিক্যাল স্টুডেন্ট মি. এল অজ্ঞান হয়ে গেলেন। নার্স দুজন দৌড়ে পালিয়ে গেল ঘর থেকে। কিছুতেই আর তাদেরকে ফিরিয়ে আনা যায়নি। আমার অবস্থাটা যে কিরকম দাঁড়িয়েছিল সেই মুহূর্তে, পাঠকের কাছে তা ধোঁয়াটে রাখতে চাই না। বুদ্ধিশুদ্ধি একেবারে লোপ পেয়েছিল বললেই চলে। ঘণ্টাখানেক কারও মুখে আর একটা শব্দও বেরোয়নি। একনাগাড়ে মি. এল-এর জ্ঞান ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে গেছি। উনি জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর কথাবার্তা শুরু হলো ভালডিমারের অবস্থা নিয়ে।