উদ্ভট আইডিয়াটা মাথায় আসতে এই সব কারণেই মঁসিয়ে ভালডিমারের কথাটাই মনে এল সবার আগে। ওঁর মনের চেহারা আমার অজানা নয়-আমার অদ্ভুত এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে বাধা দিতে যাবেন না। আমেরিকায় ওঁর কোনো আত্মীয়-স্বজনও নেই যে বাগড়া দিতে আসবে। তাই প্রসঙ্গটা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করলাম ভদ্রলোকের সঙ্গে। অবাক হলাম তাঁর আগ্রহ আর উত্তেজনা দেখে। অবাক হওয়ার কারণ আছে বইকি। আমার সম্মোহনের খপ্পরে বারবার নিজেকে সঁপে দিয়েও সম্মোহনের বিদ্যেটা নিয়ে কস্মিনকালেও গদগদ হননি ভালডিমার। ব্যাধিটা এমনই যে মৃত্যু কবে হবে কখন হবে তা যখন সঠিকভাবে হিসাব করে বলে দেওয়া সম্ভব নয় তখন উনি বললেন, ডাক্তাররা যখনই বলে যাবে মৃত্যুর দিন আর সময়, তার ঠিক চব্বিশ ঘন্টা আগে উনি আমাকে ডেকে পাঠাবেন।
মাস সাতেক আগে ভালডিমারের স্বহস্তে লেখা এই চিঠিটি পেলাম :
মাই ডিয়ার পি–
স্বচ্ছন্দে এখন আসতে পারেন। কাল মাঝরাত পর্যন্ত আমার আয়ু-বলে। গেলেন দুজন ডাক্তার। সময় হয়েছে। চলে আসুন।
ভালডিমার
চিঠি লেখার আধঘণ্টা পর চিঠি পৌঁছোলো আমার হাতে, তার ঠিক পনেরো মিনিট পর আমি পৌঁছোলাম মুমূর্ষ মানুষটার শয্যার পাশে। দিন দশেক তাঁকে দেখিনি। কিন্তু দশ দিনেই চেহারার হাল যা হয়েছে, আঁতকে ওঠার মতো। মুখ সিসের মতো বিবর্ণ; চোখ একেবারেই নিষ্প্রভ; এতটাই ক্ষীণকায় হয়ে গেছেন যে গালের চামড়া কুঁড়ে যেন হনু বেরিয়ে আসতে চাইছে। অবিরল শ্লেষ্ম বেরোচ্ছে। নাক-মুখ দিয়ে। নাড়ি প্রায় নেই বললেই চলে। তা সত্ত্বেও অটুট মনোবল আর শেষ দৈহিক শক্তিকে আঁকড়ে থাকার ফলে টিকে আছেন এখনো। চাঙ্গা হওয়ার। জন্য নিজেই ওষুধ নিয়ে খেলেন। ঘরে যখন ঢুকলাম, দেখলাম পকেটবুকে কি লিখছেন। কথা বললেন সুস্পষ্ট স্বরে। দুপাশে দাঁড়িয়ে দুই ডাক্তার। বালিশে ঠেস দিয়ে বসে আছেন ভালডিমার কোনোমতে পিঠ সোজা করে।
ডাক্তার দুজনকে আড়ালে ডেকে এনে শুনে নিলাম বন্ধুবরের শরীরের অবস্থা। বাঁদিকের ফুসফুস গত আঠারো মাস ধরে শক্ত হয়ে এসেছে এবং এখন তা একেবারেই অকেজো। ডানদিকের ফুসফুসের ওপরের অংশের অবস্থাও তাই। নিচের দিকটা দগদগে হয়ে রয়েছে অসংখ্য ক্ষতে। কয়েক জায়গায় ফুসফুস একেবারেই ফুটো হয়ে গেছে এবং পাঁজরার সঙ্গে আটকে রয়েছে। ডানদিকের এই অবস্থা ঘটেছে সম্প্রতি। ফুসফুস শক্ত হয়েছে খুবই তাড়াতাড়ি-অস্বাভাবিক গতিবেগে। একমাস আগেও লক্ষণ ধরা পড়েনি। ফুসফুস যে পাঁজরার সঙ্গে লেগে রয়েছে, এটা ধরা পড়েছে মাত্র তিন দিন আগে। থাইসিস ছাড়াও হৃদ্যন্ত্রের মূল ধমনীও নিশ্চয় বিগড়েছে-যদিও তা যাচাই করে দেখা এখন আর সম্ভব নয়। কেননা, ভালডিমার মারা যাবেন রবিবার রাত বারোটা নাগাদ। একথা হলো শনিবার সন্ধ্যে সাতটার সময়ে।
ডাক্তারদের বললাম, পরের দিন রাত দশটা নাগাদ যেন রোগীর বিছানার পাশে হাজির থাকেন। বিদায় নিলেন দুই ডাক্তার। ভালডিমারের পাশে বসলাম। শরীরের বর্তমান অবস্থা আর আসন্ন এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করলাম। ঐরকম শোচনীয় অবস্থাতেও ওঁর আগ্রহ তিলমাত্র কমেনি দেখে অবাক হলাম। তাড়া লাগালেন সময় নষ্ট না করে তক্ষুনি যেন শুরু করে দিই এক্সপেরিমেন্ট। দুজন নার্স ছিল ঘরে। কিন্তু নির্ভরযোগ্য সাক্ষী সামনে না রেখে কাজ শুরু করতে মন চাইল না। দুর্ঘটনা ঘটতে কতক্ষণ? তাই বললাম, এক্সপেরিমেন্ট শুরু হবে পরের দিন রাত আটটা নাগাদ। আটটার সময়ে একজন মেডিক্যাল স্টুডেন্টকে রাখব ঘরের মধ্যে। ছোকরার নাম থিওডোরের। ডাক্তাররা না এসে পৌঁছানো পর্যন্ত অপেক্ষা করলেই ভালো হতো। কিন্তু ভালডিমারের পীড়াপীড়িতে আর তার শারীরিক অবস্থা দেখে বেশি দেরি করতে চাইলাম না।
মি. এল যা দেখেছিলেন এবং যা শুনেছিলেন-সব হুবহু লিখে নিয়েছিলেন। তাঁর সেই লেখা থেকেই এই প্রতিবেদন হাজির করছি আপনাদের সামনে।
পরের দিন আটটার সময়ে ভালডিমারের হাত ধরে জিজ্ঞেস করলাম–যতদুর পারেন, স্পষ্টভাবে বলুন মি. এল-এর সামনে এই এক্সপেরিমেন্টে আপনার সায় আছে কিনা।
ক্ষীণ কিন্তু সুস্পষ্ট স্বরে উনি বললেন–হ্যাঁ, আমি সম্মোহিত হতে চাই এক্ষুনি। অনেক দেরি করে ফেলেছেন। সঙ্গে সঙ্গে শুরু করলাম হস্তচালান-যেভাবে এর আগে ওঁকে ঘুম পাড়িয়েছি বহুবার-ঠিক সেইভাবে। কপালে দু-একবার টোকা দিতেই শুরু হয়ে গেল সম্মোহনের প্রভাব। কিন্তু দশটা নাগাদ ডাক্তার দুজন এসে না পৌঁছানো পর্যন্ত সেরকম ফল পেলান না। ডাক্তারদেও জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ওঁদের কোনো আপত্তি আছে কিনা। ওঁরা বললেন, রোগীর মৃত্যুযন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে-এখন অনায়াসেই সম্মোহনের ঝুঁকি নেওয়া চলে। আমি তখন হাত চালালাম নিচের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম ভালডিমারের ডানচোখের দিকে।
ওঁর নাড়ি তখন অতিশয় ক্ষীণ, আধমিনিট অন্তর নিশ্বাস ফেলছেন অতিকষ্টে।
পনেরো মিনিট অব্যাহত রইল এই অবস্থা। তারপর গভীর শ্বাস ফেললেন ভালডিমার। নিশ্বাসের কষ্ট আর রইল না-কিন্তু আধমিনিটের ব্যবধানটা থেকেই গেল। হাত-পা বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে এল।
এগারোটা বাজার পাঁচ মিনিট আগে প্রকৃত সম্মোহনের মোক্ষম লক্ষণগুলো প্রকাশ পেল। ঘুমের ঘোরে যারা হেঁটে বেড়ায়, তাদের চোখের সাদা অংশে যেরকম একটা ভাব ফুটে ওঠে, ঠিক সেইরকম ভাব প্রকাশ পেল তাঁর চোখে। দ্রুত হাত চালালাম বার কয়েক। থিরথির করে কেঁপে উঠে বন্ধ হয়ে গেল চোখের পাতা। তাতেও সন্তুষ্ট না হয়ে জোরে জোরে আরও কয়েকবার হাত চালিয়ে এবং আমার ইচ্ছাশক্তিকে পুরোপুরি খাঁটিয়ে শক্ত এবং সহজ করে আনলাম ওঁর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। দু-পা দু-হাত সটান বিছানার ওপর মেলে ধরে মাথা ঈষৎ উঁচিয়ে স্থির হয়ে রইলেন ভালডিমার।