অনেক চেষ্টায় সে মনে বল এনে সাহসের সঙ্গে বিছানার দিকে এগিয়ে গেল। দেখল, বিছানার ওপরে যেখানে ফিল্ড শুয়ে ঘুমিয়েছিল সেখানে দেহের চাপ পড়ে একটা ছাপ তৈরি হয়েছে। বালিশে মাথা রাখার দাগ, নিচের দিকে বিছানার যেখানে বুটজুতো পরা পা রেখেছিল সেখানটা গর্ত হয়ে গেছে। আর সে বিছানার এত কাছে ছিল যে, পরিষ্কার নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল।
ম্যারিয়ট হঠাৎ চিৎকার করে তার বন্ধুর নাম ধরে ডাকতে লাগল-ফিল্ড! তুমি কোথায়? তুমি কি বাথরুমে গেছ? কোথায় তুমি?
কোনো সাড়া নেই। বিছানা থেকে তখনো নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। ম্যারিয়টের নিজের গলার আওয়াজ নিজের কানেই অদ্ভুত ঠেকছে। আর সে ডাকল না। হাঁটু গেড়ে বসে বিছানার ওপরে নিচে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখল। শেষে তোশক তুলে ফেলল, একটার পর একটা চাদর তুলে দেখতে লাগল। যদিও ফিল্ডকে দেখা যাচ্ছিল না তবু সে তার নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে লুকিয়ে থাকতে পারে। দেয়ালের কাছ থেকে খাটটা টেনে নিয়ে এল তবু শব্দটা সেখান থেকে অবিরাম আসতে লাগল।
ক্লান্তিকর এ অবস্থায় ম্যারিয়ট মাথাটা ঠিক রাখার চেষ্টা করছিল, কিন্তু বারবারই সে টালমাটাল হয়ে যাচ্ছিল। সামলাতে পারছিল না নিজেকে। সে তন্নতন্ন করে সমস্ত ঘর, বাথরুম খুঁজে দেখল। কোথাও কারও চিহ্ন নেই। ঘরের ওপর দিকে ছোট জানালাটা বন্ধ। তবে ওটা বেড়াল যাবার মতোও চওড়া নয়। বসার ঘরের দরজাটা ভেতর দিক থেকে বন্ধ। সেপথ দিয়ে ফিল্ড বেরিয়ে যেতে পারে না। অদ্ভুত সব চিন্তা ম্যারিয়টের মনকে অস্থির করে তুলল। ভেতরটা তার তোলপাড় হয়ে যাচ্ছিল। আবার সে বিছানা উল্টেপাল্টে ভালো করে দেখল। দুটো ঘর, বাথরুম আবার খুঁজে এল। না, কোথাও কিছু নেই। সে দরদর করে ঘামছিল। ঘরের কোণে বিছানায় যেখানে ফিল্ড শুয়েছিল সেখান থেকে তখনো নিশ্বাসের শব্দ ভেসে আসছিল।
তখন সে অন্যভাবে চেষ্টা করল। খাটটা যেখানে ছিল, সেখানে টেনে এনে সেই বিছানার ওপর শুয়ে পড়ল। শোবার সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে সে বিছানা ছেড়ে মেঝেতে দাঁড়িয়ে পড়ল। নিশ্বাসটা একেবারে তার মুখের ওপর পড়ছে
ম্যারিয়ট দ্রুত পড়ার ঘরে ফিরে গিয়ে সবকটা জানালা খুলে দিল। ঘরে আলো হাওয়া খেলতে লাগল। আগাগোড়া সমস্ত ব্যাপারটা ধীরে সুস্থে চিন্তা করার চেষ্টা করল। সে জানত, যারা খুব বেশি পড়াশোনা করে এবং কম ঘুমোয়, তাদের মনে নানা অলীক, অবাস্তব চিন্তা জেগে উঠে যন্ত্রণা দেয়। আবার মনকে সে শান্ত করে রাতের ঘটনাগুলো পরপর বিশ্লেষণ করেও কোনো কূলকিনারা পেল না।
এসব খতিয়ে দেখে আর বিশ্লেষণ করতে করতে একটা বিস্ময়কর ব্যাপার হঠাৎ তার মনে উদয় হলো। ফিল্ড কিন্তু একবারও মুখ দিয়ে একটাও শব্দ বার করেনি! তার ভাবনা চিন্তাকে ঠাট্টা করার জন্য তখনো ভেতরের ঘর থেকে দীর্ঘ গভীর ও স্বাভাবিক নিশ্বাসের শব্দ আসছে! একটা অবিশ্বাস্য অযৌক্তিক ব্যাপার!
ভুতুড়ে চিন্তার জালে জড়িয়ে পাগলের মতো মাথায় টুপি ও গায়ে বর্ষাতি চাপিয়ে বাড়ি থেকে সে বেরিয়ে পড়ল। সকালের বিশুদ্ধ বাতাস, গাছগাছালির বুনো গন্ধ, আর স্যাঁতসেতে ভিজে মাটির ওপর ঘুরে বেড়িয়ে যখন সে বুঝতে পারল, মন থেকে ভয় দূর হয়েছে, খিদেও পেয়েছে বেশ, তখন সে বাড়ি ফিরে এল।
ঘরে ঢুকতেই দেখল একজন লোক জানালায় হেলান দিয়ে বসে আছে। তাকে দেখে ম্যারিয়ট প্রথমটায় চমকে উঠলেও পরে তাকে চিনতে পারল। এ তার বন্ধু গ্রিন-তার সঙ্গে পরীক্ষা দেবার জন্য তৈরি হচ্ছে।
সে বলল, সারা রাত খুব পড়েছ, ম্যারিয়ট। ভাবলাম, তোমার সঙ্গে নোটগুলো মিলিয়ে নিই, আর ব্রেকফাস্টটাও করি। তাই তোমার কাছে চলে এলাম। তুমি এত সকালে কোথায় গেছিলে? বাইরে?
ম্যারিয়ট বলল, মাথাটা ধরেছিল, তাই একটু বেড়িয়ে এলাম।
ও! গ্রিনের কণ্ঠে বিস্ময়। একজন পরিচারিকা ঘরে ঢুকে গরম গরম পরিজ টেবিলে রেখে বেরিয়ে গেল। গ্রিন বলল, ম্যারিয়ট, তোমার মদে আসক্তি আছে। জানতাম না তো!
নীরস সুরে ম্যারিয়ট বলল সে নিজেও তা জানে না।
মনে হচ্ছে বিছানায় কেউ আরামে ঘুমিয়ে আছে, তাই না? মাথা নেড়ে ছোট শোবার ঘরটা দেখিয়ে কৌতূহলী হয়ে ম্যারিয়টের দিকে তাকিয়ে রইল।
দুজনে কয়েক মুহূর্ত পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকার পরে সাগ্রহে ম্যারিয়ট বলল, তাহলে তুমিও শুনেছ? ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।
নিশ্চয়ই আমি শুনেছি। দরজা খোলা রয়েছে। আমি যে ঘরে ঢুকে পড়েছি তুমি কিছু মনে করোনি তো?
না, না। আমি কিছু মনে করিনি। ম্যারিয়ট নিচু স্বরে বলল, এখন আর আমার ভয় করছে না। আমি ব্যাপারটা বলি। ভেবেছিলাম আমার মাথায় কোনো গোলমাল হয়েছে। তুমি জানো, এই পরীক্ষার ওপর আমার অনেক কিছু নির্ভর করছে। অথচ আমি পড়ায় মন বসাতে পারছি না। সাধারণত কোনো শব্দ, দৃশ্য অথবা অলৌকিক চিন্তার মধ্যে ডুবে থাকলে এমনটা হতে পারে কিন্তু আমি… বাজে যত্তসব!
তার কথার মাঝে হঠাৎ গ্রিন বলল, তুমি কিসের কথা বলছ?
শান্তস্বরে ম্যারিয়ট বলল, আমার কথা শোনো, গ্রিন। আমি যা বলতে চাই, পরপর বলে যাব-তুমি কোনো বাধা দেবে না। রাতে যা যা ঘটেছিল সবিস্তারে বলল ম্যারিয়ট। হাতের ব্যথার কথাটাও বাদ দিল না। বলা শেষ হলে টেবিল থেকে উঠে সে ঘরের ওপাশে গেল। বলল, এখন তুমি স্পষ্ট নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছ তো? তাই না?