শেষ কেকটি ফিল্ড গলাধকরণ করার পর বোকার মতো ম্যারিয়ট বলল-তোমাকে দেবার মতো আমার আর কিছুই নেই।
ফিল্ড কিছুই বলল না। তার নিজের জায়গায় প্রায় ঘুমিয়ে পড়ার দশা। ক্লান্ত ও কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে সে একবার চোখ তুলে দেখল।
এখন তোমার একটু ঘুমের দরকার, নইলে শরীর খারাপ করবে। আমাকে সারা রাত জেগে পড়াশোনা করতে হবে। আমার বিছানায় তুমি আরাম করে শোও। কাল একটু বেলাতে ব্রেকফাস্ট করব কেমন, আর-আর দেখি কি করা যায়। ঘরের গুমোট পরিবেশ হালকা করার জন্য ম্যারিয়ট বলল।
ফিল্ড যেন মৃত্যুর নীরবতা পালন করে চলেছে। তার মৌনতা সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে ম্যারিয়ট তাকে নিজের ছোট শোবার ঘরে নিয়ে গেল। ফিল্ড জমিদারের ছেলে। তাদের বিশাল অট্টালিকা। তার কাছে এই ছোট সামান্য ঘরটা নেহাতই পুতুলঘরের মতোই।
ক্লান্ত ফিল্ড কোনো ধন্যবাদের ধার না ধেরে কিংবা ভদ্রতার ভান না করে বন্ধুর হাতে ভর দিয়ে পা টেনে টেনে ঘরে ঢুকল। ম্যারিয়ট তাকে তার গায়ের পোশাকসুদ্ধ বিছানায় শুইয়ে দিল।
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ম্যারিয়ট তার আপাদমস্তক দেখল। পরমুহূর্তেই তার চিন্তা হলো, এই অনাহুত অতিথিকে নিয়ে কাল সে কি করবে? কিন্তু বেশিক্ষণ এ ভাবনা তাকে উতলা করতে পারল না, কারণ পরীক্ষার টেনশনটা তাকে বড় খোঁচাচ্ছে।
দরজায় খিল লাগিয়ে সে আবার পড়তে বসল বই নিয়ে। মেটিরিয়া মেডিকার যেখান থেকে নোট করতে করতে কলিংবেল শুনে উঠে গিয়েছিল, সেখানে আবার মনোনিবেশ করল। কিন্তু সে বেশ খানিকক্ষণ মনোসংযোগ করতে পারল না। তার চিন্তা কেবলই সেই মূর্তিটিতে ঘুরপাক খাচ্ছে-সাদা ফ্যাকাসে মড়ার মতো মুখ, অদ্ভুত জ্বলন্ত চোখ, ক্ষুধার্ত ও মলিন বেশ, পোশাক ও জুতো পরে ফিল্ডের বিছানায় শুয়ে থাকা।
হঠাৎ ম্যারিয়টের একটা শপথের কথা মনে পড়ে গেল। ইস্ একেবারে ভুলে গিয়েছিল!
ম্যারিয়ট আধখোলা দরজা দিয়ে ছোট শোবার ঘরটা থেকে গভীর দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। শ্রান্ত, ক্লান্ত মানুষের গভীর নিদ্রা তাকেও বিছানার দিকে আকর্ষণ করছিল।
ম্যারিয়ট ভাবছে, একটু ঘুমিয়ে নেওয়া যাক, খুব ঘুম পাচ্ছে।
তখন বাইরে সোঁ সোঁ শব্দে ঠান্ডা বাতাস বইছে; সার্সিতে এবং রাস্তায়। অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। ম্যারিয়ট পুনরায় পড়ায় মনোসংযোগ করার চেষ্টা করল; কিন্তু বই পড়তে পড়তে সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল পাশের ঘরের লোকটির ভারি ও গভীর নিশ্বাস!
প্রথমে, হয় ঘরের অন্ধকারে সে কিছু দেখতে পাচ্ছিল না। নয়তো, আলোয় এতক্ষণ বসে থাকার কারণে তার চোখ ধাধিয়ে গিয়েছিল। কিছুই সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না-আসবাবগুলো কালো ঢেলার মতো, দেয়ালে ড্রয়ারের আলমারিটা একটা কালো বস্তু, ঘরের মাঝখানে সাদা বাথটাবটা যেন একটা সাদা প্রলেপ।
তারপর ধীরে ধীরে বিছানার দিকে তাকাতেই দেখল তার ওপর একটা ঘুমন্ত দেহের রেখা ক্রমে ক্রমে আকার নিল। তারপর অন্ধকারের মধ্যে অদ্ভুতভাবে সে বাড়তে লাগল। পরিষ্কার দেখা গেল বিছানার সাদা চাদরের ওপর একটা লম্বা কালো মূর্তি।
মনে মনে হাসল ম্যারিয়ট। ফিল্ড একটুও নড়েনি। কয়েক মুহূর্ত তাকে দেখে ম্যারিয়ট আবার বইয়ের কাছে ফিরে এল।
একটানা বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়া বয়ে চলেছে। বাইরে গাড়ির কোনো শব্দ নেই, তবে দুধের গাড়ি চলার সময় এখনো হয়নি। ম্যারিয়ট পড়তে লাগল। ঘুম আসছিল বলে মাঝে মাঝে ঘুম তাড়াবার জন্য কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে। তারই মধ্যে ফিল্ডের গভীর নিশ্বাস তার কানে আসছে।
বাইরে তখনো ঝড় থামেনি। সঙ্গে অবিরাম বৃষ্টি। ঘরের মধ্যে নিঃসীম নিস্তব্ধতা। টেবিল ল্যাম্পের আলো টেবিলে ছড়িয়ে আছে বাকি ঘরের সবটাই অন্ধকারাচ্ছন্ন। ছোট শোবার ঘরটা-যেখানে ফিল্ড শুয়ে আছে সে যেখানে বসে আছে ঠিক তার উল্টোদিকে, তার পড়ায় ব্যাঘাত ঘটাবার মতো কিছুই নেই, তবে মাঝে মাঝে ঝড়ের ঝাঁপটা জানালার ওপর পড়ছে আর হাতে সামান্য একটু ব্যথা অনুভব করছে।
এই ব্যথাটা যে কী করে হলো তা সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না, বেশ টনটন করছে। ম্যারিয়ট মনে করার চেষ্টা করছে, কেমন করে, কখন এবং কোথায় তার হাতে ধাক্কা লেগেছিল কিন্তু কিছুই ভেবে পাচ্ছে না।
নিচে রাস্তায় গাড়ির শব্দে সে সম্বিৎ ফিরে পেল। ঘড়ির দিকে তাকালো। ভোর চারটা। ম্যারিয়ট চেয়ারে হেলান দিয়ে বিরাট হাঁ করে হাই তুলল। তারপর উঠে জানালার পর্দাগুলো সরিয়ে দিল। ঝড়বৃষ্টি থেমে গেছে। বাইরে ঘন কুয়াশায়– দৃষ্টি চলে না। ব্রেকফাস্টের আগে সোফায় শুয়ে বাকি চার ঘণ্টা ঘুমিয়ে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল ম্যারিয়ট। কিন্তু তখনো সেই শোবার ঘরটা থেকে গভীর নিশ্বাস ফেলার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। আর একবার নিঃশব্দে আধখোলা দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে ভোরের মৃদু আলোয় বিছানাটা পরিষ্কার দেখতে পেল। বিছানায় কেউ নেই। একবার চোখটা কচলে নিল ভালো করে। অবাক বিস্ময়ে তার মুখটা হাঁ হয়ে গেল। বিছানা শূন্য, ঘরেও কেউ নেই।
ফিল্ডের প্রথম আবির্ভাবে যে ভয় ম্যারিয়টের মনে জেগে উঠেছিল সেই ভয় হঠাৎ যেন সে আবার অনুভব করতে লাগল। এবার যেন আরও বেশি। সেইসঙ্গে সে সচেতন হয়ে উঠল তার বাঁ হাতটা দপদপ, টনটন করছে, আরও বেশি সে যন্ত্রণা বোধ করছে। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ম্যারিয়ট। চিন্তা করার শক্তি ক্রমশ হারিয়ে ফেলেছে। আপাদমস্তক ঠকঠক করে কাঁপছে।