আগন্তুক বয়সে তরুণ, বেঁটে, খাটো, মোটা। মুখটা চুনের এত সাদা, উজ্জ্বল চোখ দুটোর তলায় কালি পড়েছে। একমুখ দাড়ি, চুল আলুথালু আর পোশাকের। পরিপাট্য দেখে তাকে ভদ্রলোক বলেই মনে হলো ম্যারিয়টের। সব থেকে আশ্চর্যের ব্যাপার তার মাথায় কোনো টুপি নেই এমনকি গায়ে ওভারকোট বা হাতে ছাতাও নেই। অথচ সন্ধ্যে থেকেই অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে।
লোকটিকে দেখে ম্যারিয়টের মনে নানারকম প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছিল। তার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হচ্ছিল-কে আপনি? আর কেনই-বা এত রাতে এখানে এসেছেন? রাস্তার গ্যাসের আলো তার মুখের ওপর পড়ল। চমকে উঠল ম্যারিয়ট। চিনতে পারল আগন্তুককে। ফিল্ড! ফিল্ড, তুমি বেঁচে আছ? ভয়ে ম্যারিয়টের দমবন্ধ হবার জোগাড় হলো।
ম্যারিয়ট এই ফিল্ডের সঙ্গে একই স্কুলে পড়ত। সে যা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল তাই-ই হয়েছে। তার বাবা তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তার সঙ্গে পরে একবারই মাত্র দেখা হয়েছিল। ম্যারিয়টের বাড়ির কাছেই ফিল্ড থাকত তাই তার বোনদের মারফত সব খবরই ম্যারিয়ট পেত। ফিল্ড অসংযত জীবনযাপন করত, মদ, আফিং, চরসের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকত। সে একেবারে উচ্ছন্নে চলে যায়।
ম্যারিয়টের রাগ-বিরক্তি মুহূর্তে দূর হয়ে গেল। সে তাকে ভেতরে আসতে বলল। বলল, মনে হচ্ছে কিছু ঘেট পাকিয়েছ। এসো ভেতরে, সব শুনছি। আমাকে সব খুলে বলো–হয়তো আমি কোনো সাহায্য…আর কি বলবে ম্যারিয়ট ভেবে পেল না, শুধু সে তো তো করতে লাগল। তারপর নিজেকে সংযত করে, সদর দরজাটা বন্ধ করে বন্ধুকে নিয়ে হলের দিকে এগোল। ফিল্ড খুব পরিশ্রান্ত এবং ক্লান্ত। তার টলায়মান পা দুটো দেখলেই বোঝা যায়। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে অনেকদিন সে কিছু খায়নি।
ম্যারিয়ট এবার হাসিমুখে সমবেদনার স্বরে বলল–আমার সঙ্গে এসো, তোমাকে দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি। এইমাত্র আমি খেতে যাচ্ছিলাম, তুমি ঠিক সময়েই এসেছ।
ফিল্ডের দিক থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। সে এতই দুর্বলভাবে হাঁটছিল যে ম্যারিয়ট তার হাতটা ধরে নিয়ে চলল। এই প্রথম সে লক্ষ করল ফিল্ডের জামা কাপড় তার গায়ে মোটেই ফিট করেনি। খুব ঢিলেঢালা লাগছে। তার বিরাট চেহারাটা কঙ্কালসার।
ফিল্ডকে ঘরে নিয়ে গিয়ে সোফাতে বসালো ম্যারিয়ট। আশ্চর্য হচ্ছিল ভেবে কোথা থেকে ফিল্ড এল আর কী করেই-বা সে তার ঠিকানা জানল।
ম্যারিয়ট বলল, ফিল্ড, তুমি সোফায় বিশ্রাম করো কিছুক্ষণ, তুমি খুব ক্লান্ত। পরে তোমার কাছে সব শুনব। তখন দুজনে মিলে যা হোক একটা কিছু ঠিক করা যাবে।
ফিল্ড সোফায় বসে কোনো কথা না বলে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। ম্যারিয়ট আলমারি থেকে বাদামি রঙের পাউরুটি, কেক এবং একটা বড় পাত্রে কমলালেবুর আচার বের করল। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল ফিল্ডের চোখ দুটো ভীষণ চকচক করছে। ম্যারিয়ট ভাবল এটা নিশ্চয়ই কোনো ওষুধের প্রভাব। ওর অবস্থা খুবই শোচনীয়। কথা বলবার শক্তিও বোধহয় তার নেই।
ম্যারিয়ট কোকো তৈরি করার জন্য স্পিরিট ল্যাম্প জ্বালাল। পানি যখন ফুটছে তখন খাবার টেবিলটা সোফার কাছে টেনে নিয়ে এল যাতে ফিল্ডের চেয়ারে উঠে গিয়ে বসতে কষ্ট না হয়। এসো, এখন খাওয়া যাক। বলল ম্যারিয়ট। তারপর পাইপ টানতে টানতে গল্প করব। এবার পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছি। যদিও খুব ব্যস্ত এখন আমি, তবুও তোমার এত বন্ধুকে কাছে পেয়ে খুবই ভালো লাগছে।
ম্যারিয়ট আবার ফিল্ডের দিকে তাকিয়ে দেখল তার অতিথি বন্ধুটি তার দিকেই একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। ম্যারিয়টের মাথা থেকে পা পর্যন্ত একটা শিহরন বয়ে গেল। ফিল্ডের মুখ মরার মতো ফ্যাকাসে। ব্যথা ও মানসিক কষ্টের একটা ছাপ তার মুখে ফুটে উঠেছে।
এইরে! ম্যারিয়ট লাফিয়ে উঠল। একেবারে ভুলেই গেছিলাম। বলে আলমারি থেকে মদের বোতল আর গেলাস বার করল। গেলাসে মদ ঢেলে ফিল্ডকে দিল। ফিল্ড পানি না মিশিয়ে সেটা এক ঢোকে শেষ করল। ম্যারিয়ট লক্ষ করল ফিল্ডের কোটটা ধুলোয় ভর্তি, কাঁধে মাকড়সার জাল। কোটটা শুকনো খটখটে। বৃষ্টি ঝরা রাতে ফিল্ড এসেছে-টুপি, ছাতা, ওভারকোট কিছুই নেই-অথচ শুকনো, এমনকি ধুলোভর্তি! ব্যাপারটার অর্থ কিছুতেই মেলাতে পারছিল না ম্যারিয়ট। তবে কি ফিল্ড এই বাড়িতেই কোথাও লুকিয়েছিল?
তবু ম্যারিয়ট কিছুই জিজ্ঞেস করল না। ঠিক করেছে, ফিল্ডের খাওয়া ও ঘুম হওয়া পর্যন্ত তাকে কোনো কথা জিজ্ঞাসা করবে না। খাবার এবং ঘুম-দুটোই এখন তার খুবই প্রয়োজন। একটু সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ফিল্ডকে কিছু জিজ্ঞাসা করা ঠিক হবে না।
তারা দুজনে খেতে লাগল। ম্যারিয়ট একাই কথা বলে যাচ্ছে। তার নিজের সম্বন্ধে, তার পরীক্ষার ব্যাপারে, বুড়ি বাড়িওয়ালির কথা-একনাগাড়ে বলেই চলেছে। ম্যারিয়টের খাবার কোনো ইচ্ছা নেই, হাতে খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। যদিও ফিল্ড গোগ্রাসে গিলছে। একজন ক্ষুধার্তের এভাবে ঠান্ডা, বাসি খাবার খাওয়ার আগ্রহ দেখে ম্যারিয়ট ভাবছিল, ফিল্ডের গলায় আবার খাবার আটকে না যায়!
কিন্তু ফিল্ড যেমন ক্ষুধার্ত ছিল তেমনি তার ঘুম পাচ্ছিল। মাঝে মাঝে তার মাথা সামনের দিকে ঝুলে পড়ছে, মুখের খাবার চিবোনো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ম্যারিয়ট বারবার তাকে ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়ে রাখছিল। আর ফিল্ড পশুর এত গরগর করে খাবার মুখে পুরে সরু গলনালি দিয়ে গিলে ফেলছে।