কতক্ষণ বসে থেকে মন সংহত করার চেষ্টা করেছিলাম জানি না, হতে পারে। পাঁচ মিনিট, তবে মনে হলো অনন্তকাল। শেষ পর্যন্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে আমি পোশাক পরতে শুরু করলাম। পাশের ঘরেই সেই মূর্তিমান আতঙ্ক। একথা জানার পর আর ঘুমানো সম্ভব নয় এবং ওই বাথরুমেই যে দেহটা কোথাও লুকানো আছে তাতে সন্দেহ নেই। নিশ্চয়ই তার শরীরের সমস্ত রক্ত নিমিষে নিংড়ে নেওয়া হয়েছে। যেন প্রকাণ্ড কোনো জোক তার সব রক্ত শুষে নিয়ে ওই টবে রেখেছে।
হ্যাঁ, জোঁক, জোকই বটে-অন্ধ সরাইয়ের মালিককে জোঁকের সঙ্গে তুলনা করা যায়। কে ওর পরবর্তী শিকার হতে চলেছে? শিউরে উঠল শরীর। দৌড়ে জানালার কাছে গেলাম। না ওই পথে পালানো অসম্ভব। কারণ এতক্ষণ যা আমার দৃষ্টি এড়িয়েছিল তা চোখে পড়ল। জানালার উপর থেকে নিচ পর্যন্ত রয়েছে অত্যন্ত মজবুত ছটা লোহার শিক। দৌড়ে গেলাম দরজার কাছে। সেটাও তালা দেওয়া। অর্থাৎ, আমি বন্দী।
কী করব ভেবে না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময় আবার সিঁড়ি দিয়ে ভেসে এল চটির আওয়াজ। আওয়াজটা ক্রমেই এগিয়ে আসছে। থামল দরজার সামনে।
বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছি। প্রায় নিঃশব্দে দরজায় চাবি পড়ল, একটু একটু করে দরজাটা খুলে গেল। মহা আতঙ্কে সব শক্তি হারিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বুক ধড়ফড় করছে, শিরা দপদপ করছে। কী ভয়ংকর সেই স্তব্ধতা।
হঠাৎ আমি বাকশক্তি ফিরে পেলাম, চিৎকার করে উঠলাম–যাও, চলে যাও বলছি। তারপর দরজাটার উপর ছিটকে পড়ে সেটা বন্ধ করে দিলাম। সেই আতঙ্কের মধ্যেও শুনতে পেলাম পায়ের আওয়াজ ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছে। তারপর আবার নিস্তব্ধতা। ভয় পাবার জন্য ধিক্কার দিলাম নিজেকে। কেন যে সেই অন্ধ, মূর্তিমান আতঙ্কের মাথায় ঘিলু উড়িয়ে দেইনি। তাহলেই তো পালাতে পারতাম। আসলে ওকে দেখেই আমার সারা শরীর অবশ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর আমি সাহস সঞ্চয় করে খুললাম দরজাটা। মনে ভয় জাগানোর এত গাঢ় অন্ধকার। ভিতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে দেব তাও অসম্ভব। কারণ চাবিটাই নেই।
দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে গেলাম ঘরের অন্য প্রান্তে, চেষ্টা করলাম প্রকাণ্ড সিন্দুকটাকে সরাতে। বেশ পরিশ্রমের পর কোনো রকমে তা করা গেল। সেটাকে দরজার সঙ্গে আটকে দিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। এখন আর কিছু করার নেই। শুধু ভোরের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া। আমি আলো না নিভিয়েই শুয়ে পড়লাম।
মনে মনে ঠিক করলাম পরিস্থিতি অনুযায়ী কাজ করব। অলসভাবে চিত হয়ে শুয়ে আছি, হঠাৎ দেখি, ঠিক আমার মুখের সামনে একটা বিরাট মাকড়সা একটা সুতোয় ভর করে ঝুলছে। মাকড়সাই একমাত্র আমার মনে বিতৃষ্ণার সৃষ্টি করে। সেই মাকড়সাটা সুতো ধরে ঝুলছে না। ভালো করে লক্ষ করলাম, একটা খুব সরু ধাতব পদার্থ বেয়ে নেমে আসছে ওটা।
এক দৃষ্টিতে মাকড়সাটার দিকে তাকিয়ে আছি। চেষ্টা করছি জেগে থাকতে। কিন্তু ক্লান্ত শরীর আর তা মানল না। ঘুমিয়ে পড়লাম এক সময়।
হঠাৎ অস্বস্তি নিয়ে ঘুম ভেঙে গেল। সরসর করে কী যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে গায়ের ওপর। চাপা আর্তনাদের সঙ্গে পলকের মধ্যে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে এলাম। আর সেই মুহূর্তেই সেই সুচালো অত্যন্ত ভারী ধাতব বস্তুটা যেটা থেকে মাকড়সাটা ঝুলছিল সেটা ভয়ংকর বেগে পড়ল ঠিক যেখানে আমি শুয়ে ছিলাম সে জায়গায়। আমার গায়ে সেই মাকড়সাটা ঘুরে বেড়াচ্ছিল। বলতে কি, মাকড়সাটার জন্যই আমি প্রাণে বেঁচে গেলাম।
বেশ অকৃতজ্ঞতার পরিচয় দিয়ে আমি মাকড়সাটাকে শরীর থেকে ঝেড়ে ফেললাম। এতক্ষণে বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা কি হয়েছিল। ধাতব সুচালো বস্তুটা হচ্ছে একটা বর্শার এত বস্তুর একাংশ, ছাদের একটা গর্তের ওপর তার বাকি অংশটা অদৃশ্য। মানুষ খুনের জন্য শয়তানি বুদ্ধির পরাকাষ্ঠা।
ভাগ্যের জোরেই বেঁচে গেলাম সে যাত্রা। ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ভাবছি কি করা যায়। এমন সময় মনে হলো যেন দরজার বাইরে থেকে আঁচড়ানোর আওয়াজ আসছে। না, এ আমার উত্তেজিত স্নায়ুর ভুল শোনা। তবু কান পেতে দাঁড়িয়ে থাকলাম। তারপর বিছানার পাশের দেয়ালের ওপার থেকে যে মৃদু আঁচড়ের আওয়াজ আমার কানে এল সেটা যে বাস্তব তাতে সন্দেহ রইল না।
ফিরলাম সেদিকে। দেয়ালটার একটা ফাটল একটু একটু করে স্পষ্ট হলো। তারপর সেই ফাটল দিয়ে অস্পষ্ট আলো দেখা গেল।
তাড়াতাড়ি নিভিয়ে দিলাম বাতিটা। ঠিক করলাম এবার আর আমল দেব না ভয়। মরিয়ার সাহস নিয়ে আমি বাথরুমে গিয়ে দরজাটা ফাঁক করে দেখতে। লাগলাম, নিজেকে যথাসম্ভব আড়াল রেখে। দেখলাম সেই ফাঁক ক্রমেই বড় হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত সরাইয়ের মালিক ঢুকে পড়ল সেখান দিয়ে। মুহূর্তের জন্য থেমে দাঁড়াল। তারপর হাতড়াতে হাতড়াতে, নিশব্দে, আন্দাজ করে করে আমার বিছানার দিকে এগোল, এবং হাতড়াতে হাতড়াতে ধাতব বস্তুটি অনুভব করে পরম তৃপ্তির সঙ্গে দেহটা খুঁজতে ব্যস্ত হলো। ভদ্রমহিলাও তার পিছু পিছু এগোচ্ছিল। সরাইয়ের মালিককে হতাশাব্যঞ্জক আওয়াজ করতে দেখেই সে সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা আঁচ করে ফেলল। বলে উঠল বাথরুমটা, বাথরুমটা, তাড়াতাড়ি। তারপর কিছুটা টেনে, কিছুটা ঠেলে চক্ষুহীন দানব দ্রুত আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। পলকের মধ্যে আমি সেখান থেকে পালাবার পথ খুঁজতে লাগলাম। টবের উপরের চৌবাচ্চাটার ওখান দিয়ে একটু তারার আলো চোখে পড়ল। বিদ্যুতের বেগে আমি উঠে পড়লাম সেখানে। ওখানে শুয়ে হাঁপাতে লাগলাম। একটা বিকট দুর্গন্ধ নাকে আসছে। তবুও আমি নড়াচড়া করতে সাহস পেলাম না। একটু পরেই বাথরুমের দরজাটা খুলে গেল। আততায়ীরা প্রবেশ করল। আমাকে দেখতে পাবে নাকি ওরা? মনে মনে ঈশ্বরের সাহায্য প্রার্থনা করলাম। কী যেন বলে মহিলাটি ঝুঁকে পড়ল। তারপর টবের ভেতর থেকে আন্দাজে একটা কুড়াল তুলে নিয়ে বীভৎস হাসি হেসে উঠল। যেন কোনো বন্যজন্তু মাংসের গন্ধ পেয়েছে।