বুঝলাম সরাইয়ের মালিকের মধ্যে বেশ রসবোধ আছে। ছবিটা নিয়ে চিন্তা করছিলাম, এমন সময় সরাইয়ের ভেতর হঠাৎ একটা শব্দ পেলাম। আর ডান দিকের জানালায় ক্ষীণ আলোর আভাস চোখে পড়ল আমার। কিছুক্ষণ পর আর সেই আলো দেখা গেল না। বুঝলাম আমার নক করাটাকে ওরা মনের ভুল ভেবে ফিরে যাচ্ছে। ভাবছি এবার প্রচণ্ড জোরে দরজায় ঘা দেব। এমন সময় একটা অস্ফুট শব্দ আমার কানে এল। কে যেন চটি পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে আসছে। খিল খোলার শব্দ হতেই ধীরে ধীরে দরজাটা খুলে গেল।
যাকে সামনে দেখলাম সে মানুষটি ছোটখাটো। মুখ গোলাকার। তাতে দাড়ি গোঁফ বা ভ্রুর বালাই নেই। মাথায় পুরোনো আমলের টুপি। গায়ে একটা লম্বা কালো পোশাক। তবে সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার, লোকটার চোখ বলতে কিছু নেই। দুহাত বাড়িয়ে হাতড়াতে হাতড়াতে এগিয়ে আসছে।
এ পর্যন্ত বলে শিউরে উঠল মেথুয়েন। ডাক্তার খানিকটা এগিয়ে বসলেন। বললেন, তারপর? বলে যান।
তার পাশে এক মহিলা একটা মোমবাতি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের মধ্যে বেশ পার্থক্য লক্ষ করলাম। মহিলাটি মাঝারি গড়নের। অপূর্ব সুন্দরী। কালো ভ্রু। বড় বড় দুচোখে এক আশ্চর্য জ্যোতি। আমাকে সে লক্ষ করছিল।
আমার অসুবিধার কথা জানিয়ে আশ্রয় চাইলাম। আমার গলার স্বর শুনে চক্ষুহীন, লোকটি হাত বাড়িয়ে আমার মুখ স্পর্শ করতে লাগল। ভাবলাম এ লোকই হয়তো সরাইখানার মালিক।
আমার মুখে হাত দেওয়াতে বেশ বিরক্তি লাগল। মহিলাটি বুঝতে পেরে তাকে বলল ওকে আসতে দাও, একে দিয়ে বেশ চলবে। একথা শুনে সরাইয়ের মালিক সরে দাঁড়িয়ে আমাকে হাতের ইশারায় ভেতরে ঢুকতে বলল।
আবার থামল মেথুয়েন। বিশ্বাস করুন, যদি আমি তখন কাছাকাছি অন্য কোনো আশ্রয় পেতাম, এমনকি কোনো মুরগির ঘর বা গোলাবাড়িও থাকত সেখানেই রাত কাটাতাম। এক মুহূর্তও ওই সরাইখানায় থাকতাম না। ডাক্তার সাটন মাথা নেড়ে সায় দিলেন মেথুয়েনের কথায়। মেথুয়েন আবার শুরু করল–কিন্তু আমি তখন নিরূপায়। ওরা যে আমাকে আশ্রয় দিতে রাজি হয়েছে
এই ভেবে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হলো। মালিক আমার মধ্যে যতই আতংকের সৃষ্টি করুক। জলা এলাকার বাইরে রাত কাটানোর চেয়ে তা অনেক ভালো।
মহিলাটি আমাকে কোনো কথা না বলে দোতলায় একটা শোবার ঘরে নিয়ে গেল। কিছু খাবার আর গোসল করতে চাইলে সে নেতিবাচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। ভাবলাম, সে ক্লান্ত। তাই এ নিয়ে কিছু বললাম না। এবং এভাবে রাতের বেলায় তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য দুঃখ প্রকাশ করলাম। তারপর তাকে শুভরাত্রি জানালাম। তাতে সে রহস্যপূর্ণ হাসি হেসে বেরিয়ে গিয়ে বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিল। আমি ঘরে একা রয়ে গেলাম।
ভালো করে লক্ষ করলাম ঘরটা। বিশেষ কোনো ফার্নিচারের বালাই নেই। ঘরের এক কোণে একটা বেসিন, তোয়ালে, আর দেয়াল বরাবর গোটা দুয়েক চেয়ার। আর একটা দেয়ালে খুব বড় একটা ওক কাঠের সিন্দুক। ঘরের একদিকে একটা খাট, আর অন্য দিকটায়। একটা ছোট দরজা ছাড়া আর কিছু নেই। দরজাটা খোলার চেষ্টা করলাম। ব্যর্থ হলাম। চাবির গর্ত দিয়ে তাকিয়ে অন্ধকারে ওপাশে কিছুই দেখতে পেলাম না। যা হোক, আমি ক্লান্ত, এবার ঘুমোব। পোশাক। ছাড়তে শুরু করলাম। একটা প্রকাণ্ড ব্রোঞ্জের বাতি ছাড়া ঘরে আর কোনো আলো নেই। বাতিটা জানালার কাছে একটা টেবিলের ওপরে। এত ভারী যে ওটাকে টেবিলে রাখতে মনে হয় তিনজন লোকের দরকার হয়েছিল। সেটার আলোও অস্পষ্ট। পোশাক ছাড়তে ছাড়তে মনে হলো সুন্দরী মহিলা চক্ষুহীন দৈত্যটার স্ত্রী নয়তো? তাই যদি হয় তাহলে তার জীবন নিশ্চয় অনেক কষ্টের। এমন এক লোকের সঙ্গে এমন নির্জন জায়গায় বাস করার এত শান্তি তাকে কি অপরাধে ভোগ করতে হচ্ছে কে জানে। যখন শুতে যাব, তখন আবার গোসলের ইচ্ছে প্রবল হয়ে উঠল।
আবার একবার দেয়ালের ছোট দরজাটার কাছে এগিয়ে গেলাম। দরজায় তালা দেওয়া। আমার কাছে সব সময়ই কিছু পুরোনো চাবি থাকে, যদি কখনো কাজে লাগে। এক্ষেত্রে কাজও হলো, খোলা গেল দরজাটা। আহ কি স্বস্তি গোসল করতে পারব। বাতির খোঁজ করলাম, কারণ অত বড় বাতিটা নিয়ে আসা অসম্ভব। কিন্তু পেলাম না। অগত্যা অন্ধকারেই গোসল করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
কল ছেড়ে দিলাম। শোবার ঘর থেকে যা সামান্য আলো আসছে তাতে দেখলাম, পানিতে আয়রন বেশি থাকার জন্যই বেশ কালো দেখাচ্ছে। অথবা অব্যবহারের ফলেই মরচে পড়ে পানির এই রঙ। টবটা লোহার, অত্যন্ত পুরোনো আমলের।
আমি টবে নামলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। হায় ঈশ্বর। একি? টবটার চারপাশ আর তলাটা রক্তে পিচ্ছিল। তাড়াতাড়ি লাফিয়ে উঠে এলাম। তারপর বোধহয় মুহূর্তের জন্য আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
জ্ঞান ফিরলে লক্ষ করলাম আমি টবটার পাশে শুয়ে আছি। জমে থাকা রক্তে আমার পা আর গোড়ালি লাল হয়ে গেছে।
আমার নিশ্চিত ধারণা হলো এ রক্ত মানুষের। গুছিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললাম। যখন বিছানার ফিরে যাবার শক্তি পেলাম, প্রথমেই রক্ত মুছে ফেললাম। রক্ত মোছার পর একটু সুস্থ বোধ করলাম। পুরো ব্যাপারটা শান্তভাবে ভাবতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুতেই এ সম্ভব বলে মনে হলো না। তবে রক্তের যে চিহ্ন তোয়ালেতে রয়েছে তাতে একে স্বপ্ন বলেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ সত্য এবং অত্যন্ত ভয়ংকর।