কিন্তু যেভাবে কলিংবেলের আওয়াজ হচ্ছে তাতে ডাক্তারের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে আগন্তুক মহা নাছোড়বান্দা। শেষ পর্যন্ত তিনি দরজা খুলতে বাধ্য হলেন।
দরজার বাইরে অন্ধকারে তাকাতেই ঝড়ের বেগে এক লোক প্রবেশ করল। ঘরের ভেতরে। এবং দরজা বন্ধ করে দিয়ে সে জড়িয়ে ধরল ডাক্তারকে। ডাক্তার চেষ্টা করেও হাত ছাড়িয়ে নিতে পারলেন না। আগন্তুক আরও জোরে ডাক্তারকে চেপে ধরল। কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, আপনিই কি ডাক্তার সাটন? আমার একজন ডাক্তার দরকার খুব।
হ্যাঁ, আমি সাটন, বললেন ডাক্তার।
তাহলে বলুন আমি কি পাগল? ঈশ্বরের দোহাই আপনার।
ডাক্তার উত্তর দেবার আগে তাকালেন আগন্তুকের দিকে। আশ্চর্য তার চেহারা, চুলগুলো এলোমেলো। ঘামে ধুলোয় চটচটে পোশাক ছিন্নভিন্ন। রক্ত আর ধুলো কাদায় বীভৎস হয়ে আছে তার চেহারা। চোখেও বুনোদৃষ্টি। আগন্তুকের কণ্ঠে উদ্বেগ আর আকুতির প্রকাশ দেখে ডাক্তার বললেন, খুব ভয় পেয়েছেন দেখছি! এই বলে তাকে একটা চেয়ারে বসতে দিলেন। একটু ব্র্যান্ডি এনে তাকে খেতে দিলেন। আগন্তুক ব্র্যান্ডিটুকু এক ঢেকে গিলে ফেলল। আস্তে আস্তে তার মুখে রক্তের আভাস ফুটে উঠল।
এরপর কিছুক্ষণ নীরবতা বিরাজ করল ঘরে। ডাক্তার ভালো করে তার রোগীকে লক্ষ করলেন। বুঝতে পারলেন তাড়াহুড়ার কিছু নেই, রোগী নিজেই সামলে উঠে তার অবস্থার কথা জানাবে। আগন্তুক বেশ নার্ভাস হয়ে পড়েছে তাতে সন্দেহ নেই। তার স্নায়ুর উপর যে প্রচণ্ড চাপ পড়েছে তা সহ্য করা তার পক্ষে বেশ কঠিন হচ্ছে।
ডাক্তারের ধারণাই সঠিক হলো। কিছুক্ষণ পর মুখ খুলল আগন্তুক
আমার নাম ফ্রাঙ্ক মেথুয়েন। ফটোগ্রাফির প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আমার ব্যবসা। আমার কোম্পানি মেসার্স বার্ডসে অ্যান্ড ব্ল্যাক দিন পনেরো হলো আমার উপর এই জেলার ভার দিয়েছে। আমি জানি এলাকাটা আদৌ সুবিধার নয়। কিন্তু চাকরি করতে গেলে অত বাছবিচার চলে না। প্রায়ই আমাদের এমন কিছু কাজ করতে হয় যা আমরা মোটেও পছন্দ করি না। আমি লন্ডনের মানুষ। কিন্তু আমাকে যদি ককারমাউথের কাছে হায়ারে বাধ্য হয়ে কাজ করতে হয় তখন আমার মনের অবস্থা নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন।
ডাক্তার মাথা ঝাঁকিয়ে তাকে উৎসাহ দিলেন এবং আরও দুগেলাস ব্র্যান্ডি ঢাললেন। আগন্তুক যদিও তাকে ভোরের অনেক আগে বিছানা থেকে তুলেছে তবু ডাক্তার তার ব্যাপারে বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠলেন। তাছাড়া তার ঘুমের ঘোরও অনেকক্ষণ হলো কেটে গেছে। ফায়ার প্লেসের কাঠও এতক্ষণে গনগনে হয়ে ঘরটাকে বেশ আরামদায়ক করে তুলেছে।
আগন্তুক বলে চলেছে–চেষ্টা করছি অন্য কিছু করতে। কিন্তু তেমন কিছুই করতে পারছিলাম না। এই জলা এলাকায় আর কী ব্যবসা হতে পারে। শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম ওয়ার্কিংটন আর হোয়াইট হ্যাঁভেন জেলায় চেষ্টা করে দেখব, তাই গতরাতে বাইকে করে বেরিয়ে পড়লাম। যাতে সময় থাকতে থাকতেই হোয়াইট হ্যাঁভেনের রয়্যাল হোটেলে পৌঁছে গোসল সেরে, একটু ঘুমিয়ে সকালবেলা আবার কাজে বেরোতে পারি। কিন্তু আমার ভাগ্য ছিল বিরূপ।
হঠাৎ নির্জন এলাকায় আমার বাইক অচল হয়ে গেল, আমি তখন একা নির্জন জলা এলাকায়। দেখলাম আমার পেট্রোল ট্যাংকে লিক হয়েছে। এবং বাড়তি পেট্রোলের ট্যাংকেও দেখলাম খুব সামান্য তেল আছে। নিশ্চয়ই কেউ চুরি করেছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি লিকটা চুইংগাম দিয়ে সাধ্যমতো মেরামত করে নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম। কিন্তু মাত্র সিকি মাইলের মতো এগিয়েছি, এমন সময় আবার তেল চুঁইয়ে পড়তে লাগল। সম্পূর্ণ আটকে পড়লাম আমি। রাত দশটা। চারদিকে পিচের এত অন্ধকার। ধারে কাছের গ্রাম সেখান থেকে অন্তত ছমাইলের মতো। কোথাও জনমানবের সাড়া নেই। তার উপর আবার কুয়াশা ক্রমেই ঘন হয়ে উঠছে। আমি মোটেও ভীতু নই। তবুও কেন জানি অমঙ্গলের আশঙ্কায় মন ভরে উঠল। সেই অমঙ্গল যেন আমার দুরবস্থা দেখে খুশিতে বাকবাকুম। তার নিশ্বাস আমি অনুভব করছি। তার দাঁড়াগুলো যেন আমাকে ঝোঁপের ভেতরের গর্তটার দিকে এগোতে বলছে। আমি বাধা দিতে চেষ্টা করছি। কিন্তু পারছি না। তার বিরুদ্ধে আমি যেন অসহায়।
গর্তটার কাছাকাছি গিয়ে স্বস্তির সঙ্গে অনুভব করলাম অমঙ্গলের প্রভাব আমার উপর থেকে সরে যাচ্ছে। হঠাৎ দেখলাম আমার ঠিক সামনেই একটা সরাইখানা। এতক্ষণ আমি যেটার প্রত্যাশায় ছিলাম। এ যেন নির্বান্ধব দেশে এক পরম বন্ধুর আবির্ভাব। অবশ্য সরাইখানাটা সম্পূর্ণ অন্ধকারে ঢাকা। কিন্তু যেমন করে হোক নিশ্চয় মালিককে জাগাতে পারব। ভালো খাবারের আশায় উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম, অমঙ্গলের আশঙ্কা ইতিমধ্যে দূর হয়ে গেছে। সরাইখানাটা একটা ঝোঁপের আড়ালে থাকায় এতক্ষণ চোখে পড়েনি।
সরাইখানাটা বেশ বড়ই বলা চলে। তবে একটু সেকেলে ধরনের। একটা রঙ করা সাইন চোখে পড়ল। অন্ধকারে লেখাটা পড়া সম্ভব হলো না। আমার কাছে যদিও কোনো কিছু অস্বাভাবিক ঠেকল না। তবু দেখলাম, কুয়াশায় পুরো এলাকাটা ঢাকা থাকলেও সরাইয়ের বাগানে কিন্তু মোটেই কুয়াশা নেই।
বাইক যেখানে আছে সেখানে রেখেই দরজায় গিয়ে নক করলাম। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না। দরজায় আবার নক করে আশপাশে একটু ভালো করে তাকালাম। দেখলাম সরাইয়ের দেয়ালে রোদে জলে অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া একটা ছবি। ছবিতে একটা কফিন আঁকা। চারটে মুণ্ডুহীন মানুষ কফিনটা বহন করছে। তার নিচে লেখা-পথের শেষ প্রান্ত।