বানরদের গুলি করা কারও উচিত নয়। এরা হিন্দুদের কাছে দেবতার মতোত পূজনীয় বলেই নয়-ওদের সঙ্গে মানুষের তো অনেক মিল আছে। যাকগে, আজ যাই। একটু কাজ আছে। আকস্মিক গল্পে উপসংহার টেনে দিলেন কর্নেল, লম্বা পা ফেলে দেবদারু গাছগুলোর আড়ালে চলে গেলেন।
সেরাতে কুকুরের চিৎকার কানে এল না আমার। তবে পরদিন বানর দেখতে পেলাম-সত্যিকারের বানর, ভূত নয়। বুড়ো ধাড়ি-জোয়ান মিলে সংখ্যায় কমপক্ষে কুড়ি জন হবে। গাছে বসে ওকপাতা চিবুচ্ছে। আমাকে গ্রাহ্য করল না ওরা। আমি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম ওদের দিকে।
বানরগুলো দেখতে খারাপ নয়। গায়ের নোম রুপালি-ধূসর, লেজ লম্বা, সাপের মতো। স্বচ্ছন্দে এক গাছ থেকে আরেক গাছে লাফাচ্ছে ওরা, পরস্পরের প্রতি বিনীত, দ্র আচরণ-সমভূমির লাল বানরগুলোর এত অভব্য নয়। ছোট বানরগুলো পাহাড়ের নিচে ছোটাছুটি করছে, খেলছে, কুস্তি লড়ছে স্কুলছাত্রদের মতো।
ওদেরকে ধাওয়া করার এত কোনো কুকুর নেই-প্রলুব্ধ করার মতো ডালিয়াও নেই।
ওই রাতে আবার কুকুরের ডাক শুনতে পেলাম। আগের চেয়ে উত্তেজিত হয়ে ডাকাডাকি করছে।
এবারে আর বিছানা ছেড়ে উঠছি না আমি, বিড়বিড় করে কম্বলটা টেনে দিলাম মাথার ওপরে।
কিন্তু চিৎকার-চেঁচামেচি ক্ৰমে জোরাল হয়ে উঠল, এর সঙ্গে যোগ হলো আরেকটি কণ্ঠ। কিচকিচ করছে কেউ।
হঠাৎ নারীকণ্ঠের আর্তনাদ ভেসে এল জঙ্গল থেকে। এমন ভয়ংকর চিৎকার, ঘাড়ের পেছনের চুলগুলো দাঁড়িয়ে গেল সরসর করে।
আমি লাফ মেরে বিছানা ছাড়লাম। ছুটে গেলাম জানালার ধারে।
এক মহিলা চিত হয়ে পড়ে আছে মাটিতে, তিন/চারটা প্রকাণ্ডদেহী বানর তার শরীরে চড়ে বসেছে। তারা মহিলার হাত কামড়ে মাংস তুলে নিচ্ছে, একজন কামড়ে ধরল গলা। কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করছে, চেষ্টা করছে বানরগুলোকে তাড়িয়ে দিতে। কিন্তু পারছে না। পেছন থেকে আরও কয়েকটা বানর তাদেরকে বাধা দিচ্ছে। মহিলার কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছে না কুকুরগুলোকে। মহিলা আবার রক্ত হিম করা আর্তনাদ ছাড়ল। আমি লাফ মেরে ঘরে চলে এলাম। ছোট কুঠারটি নিয়ে ছুটলাম বাগানে।
কিন্তু সবাই-কুকুর, বানর মায় রক্তাক্ত মহিলা পর্যন্ত অদৃশ্য। আমি হাতে কুঠার নিয়ে, খালি গায়ে পাহাড়ের নিচে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম।
পরদিন ঠাট্টার সুরে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন কর্নেল, এখনো রাতে কুকুরগুলোকে দেখেন নাকি?
শুধু কুকুর নয়, বানরও দেখেছি, জবাব দিলাম আমি।
হ্যাঁ, ওগুলো মাঝে মাঝে আসে এদিকে। তবে কারও ক্ষতিটতি করে না।
জানি-তবে গতরাতে কুকুরগুলোর সঙ্গে দেখেছি ওদেরকে।
তাই নাকি? অদ্ভুত ব্যাপার তো, খুবই অদ্ভুত।
কর্নেল অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকালেন। তবে আমার কথা শেষ হয়নি তখনো।
কর্নেল, বললাম আমি, আপনি কিন্তু আমাকে বলেননি মিস ফেয়ারচাইল্ড কীভাবে মারা গেছেন।
বলিনি বুঝি? বোধহয় মনে ছিল না। বয়স হয়ে যাচ্ছে তো, অনেক কিছুই মনে থাকে না। তবে মিস ফেয়ারচাইল্ডের মৃত্যুর কথা মনে আছে আমার। বেচারি, বানরগুলো তাঁকে হত্যা করে। স্রেফ টুকরো টুকরো করে ফেলছিল মহিলাকে…
কর্নেলের কণ্ঠ ক্রমে নিচু হয়ে আসে, তিনি একটা কেন্নোর দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাঁর হাতের ছুড়ি বেয়ে ওঠার চেষ্টা করছে প্রাণীটা।
ওদেরকে গুলি করা উচিত হয়নি তাঁর, বলেন তিনি, বানরকে গুলি করা কারোরই উচিত নয়-ওরা তো মানুষের মতোই, আপনি জানেন…