অতগুলো ভিন্ন জাতের কুকুর দেখে আমি খানিকটা হতবুদ্ধি হয়ে পড়ি। মাত্র হপ্তাখানেক আগে এ কটেজে উঠেছি। পড়শিদের সঙ্গে দেখা হলে হাই-হ্যালো বলি। আমার প্রতিবেশী ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্নেল ফ্যানশ একটি ককার পোষেণ। তবে ওটার রঙ কালো। আরেক প্রতিবেশী অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বৃদ্ধ দম্পতির কোনো কুকুর নেই। তারা বিড়াল পোষেণ। দুধঅলার আছে একজোড়া মংগ্রেল বা বর্ণসঙ্কর কুকুর। এবং পাঞ্জাবি শিল্পপতি, যিনি এক সাবেক রাজকুমারের প্রাসাদ কিনেছেন, তবে সেখানে থাকেন না-বাড়ি দেখাশোনা করে তাঁর এক দারোয়ান-সেই দারোয়ান বিশালদেহী তিব্বতি ম্যাস্টিফ কুকুর পুষছে।
গতরাতে দেখা কুকুরগুলোর একটির সঙ্গেও এসব কুকুরের কোনো মিল নেই।
এখানে কেউ রিট্রিভার পোষে? সান্ধ্যকালীন ভ্রমণে কর্নেল ফ্যানশর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে প্রশ্নটা করে বসলাম তাঁকে।
এমন কারও খবর আমার জানা নেই, জবাব দিলেন তিনি। ঝোঁপের মতো ভুরুর নিচে অন্তর্ভেদী চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছেন আমাকে। কেন, এমন কোনো জানোয়ার কি চোখে পড়েছে?
না, এমনি জিজ্ঞেস করলাম আর কী। এ এলাকায় প্রচুর কুকুর আছে, না?
হুঁ। প্রায় সবাই-ই কুকুর পোষেণ। তবে প্রায়ই প্যান্থারের হামলার শিকার হয় জানোয়ারগুলো। গত শীতে আমি চমৎকার একটি টেরিয়ার হারিয়েছি।
লম্বা, লালমুখো কর্নেল ফ্যানশ অপেক্ষা করতে লাগলেন আমি তাকে আর কিছু বলি কিনা-নাকি চড়াই বেয়ে উঠে হাঁপিয়ে গিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন।
ওই রাতে আবারও কুকুরের ডাক শুনতে পেলাম আমি। জানালার ধারে গিয়ে তাকালাম বাইরে। পূর্ণিমার চাঁদ আকাশে, রুপালি আলোয় চকচক করছে ওকগাছের পাতা।
কুকুরের দল গাছের দিকে তাকাল মুখ তুলে, ঘেউ ঘেউ করতে লাগল। কিন্তু গাছে কিছু চোখে পড়ল না আমার। এমনকি একটা পেঁচা পর্যন্ত নয়।
আমি কুকুরগুলোকে একটা দাবড়ানি দিলাম। জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে গেল ওরা।
পরদিন কর্নেল ফ্যানশর সঙ্গে দেখা হলে আমার দিকে প্রত্যাশার দৃষ্টিতে তাকালেন। আমার ধারণা কুকুরগুলো সম্পর্কে তিনি জানেন; কিন্তু আমি কী বলি তা শুনতে চাইছেন। আমি তাঁকে ঘটনাটা খুলে বলার সিদ্ধান্ত নিলাম।
কাল মাঝরাতে বেশ কয়েকটা কুকুর দেখেছি আমি, বললাম আমি। একটা ককার, একটা রিট্রিভার, একটা পেক, একটা ডুশন্ড এবং একজোড়া মংগ্রেল। এখন, কর্নেল, বলুন ওরা আসলে কী?
কর্নেলের চোখ জ্বলে উঠল। আপনি মিস ফেয়ারচাইল্ডের কুকুরদের দেখেছেন।
অঃ। তিনি থাকেন কোথায়?
তিনি কোথাও থাকেন না, মাই বয়। তিনি পনেরো বছর আগে মারা গেছেন।
তা হলে তাঁর কুকুরগুলো এখানে কী করছে?
বানরের খোঁজ করছে, জবাব দিলেন কর্নেল। আমার প্রতিক্রিয়া লক্ষ করার জন্য ঘুরে দাঁড়ালেন।
ঠিক বুঝলাম না।
ব্যাখ্যা করছি, বললেন কর্নেল। তার আগে বলুন আপনি ভূত বিশ্বাস করেন কিনা।
ভূত-টুত কখনো চোখে পড়েনি।
চোখে পড়েছে, মাই বয়, আপনি ভূত দেখেছেন। মিস ফেয়ারচাইল্ডের কুকুরগুলো কবছর আগে মারা গেছে-একটা ককার, একটা রিট্রিভার, একটা ডুশুন্ড, একটা পেক এবং একজোড়া মংগ্রেল; ওক গাছের নিচে, ছোট একটা টিলায় ওগুলোকে কবর দেওয়া হয়েছে। তবে ওদের মৃত্যু অস্বাভাবিক ছিল না। সবকটা বুড়ো হয়ে গিয়েছিল। তা ছাড়া তাদের মনিবনীর মৃত্যুশোকও সইতে পারেনি বেশিদিন। মিস ফেয়ারচাইল্ডের মৃত্যুর পরে প্রতিবেশীরাই কুকুরগুলো দেখাশোনা করত।
এবং আমি যে কটেজে থাকি সেখানে মিস ফেয়ারচাইল্ড থাকতেন? তিনি কি তরুণী ছিলেন?
তাঁর বয়স ছিল পঁয়তাল্লিশের কোঠায়, সুগঠিত শরীরের অধিকারিণী। বেড়াতে খুব ভালোবাসতেন। পুরুষদেরকে তেমন পাত্তা তেমন দিতেন না। আমি ভেবেছি আপনি ওঁর কথা জানেন।
না, জানি না। আমি এখানে এসেছি অল্প কদিন, জানেনই তো। কিন্তু বানর নিয়ে কী যেন বলছিলেন? কুকুরগুলো বানর খুঁজবে কেন?
ওটাই এ গল্পের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ। লম্বা লেজঅলা লেঙ্গুর বাঁদর কখনো চোখে পড়েছে আপনার? ওকের পাতা খেতে আসে।
না।
চোখে পড়বে। আজ হোক বা কাল হোক। এখানকার জঙ্গলে এ বানরগুলো দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায়। এমনিতে কারও ক্ষতি করে না, তবে সুযোগ পেলে বাগানে ঢুকে সাবড়ে দেয় যাবতীয় ফলমূল… তো, মিস ফেয়ারচাইল্ড এ বানরগুলো দুচোখে দেখতে পারতেন না। ডালিয়া ফুল খুব ভালোবাসতেন তিনি। নিজের বাগানে বিরল প্রজাতির কিছু ডালিয়ার চাষ করেছিলেন মিস ফেয়ারচাইল্ড। যারা বাগান করেন, তাঁদের প্রিয় ফুলের গাছ ধ্বংস হয়ে গেলে উন্মাদ হওয়ারই কথা। মিস ফেয়ারচাইল্ড এরপর থেকে বাগানে তাঁর কুকুরগুলোকে পাহারায় বসান। বানর দেখলেই তিনি পোষা জানোয়ারদের ওগুলোর পেছনে লেলিয়ে দিতেন। এমনকি মধ্যরাতেও। তবে বানরদের কোনো ক্ষতি করতে পারত না কুকুরের দল। বানররা তরতর করে গাছে উঠে পড়ত। কুকুরগুলো গাছের নিচে ঘেউ ঘেউ করত।
তারপর একদিন, না দিনে নয়, রাতে-প্রতিশোধের বাসনায় শটগান নিয়ে জানালার ধারে বসে পড়েন মিস ফেয়ারচাইল্ড। বানরগুলো বাগানের কাছে আসামাত্র একটাকে গুলি করে মেরে ফেলেন।
বিরতি দিলেন কর্নেল। তাকালেন ওকগাছের দিকে। বিকেলের উষ্ণ আলোয় ঝলমল করছে গাছগুলো।
কাজটা তাঁর করা উচিত হয়নি, বললেন তিনি।