.
সেদিন সারাক্ষণ নিজের পূর্বপুরুষের কথা ভাবল রোজমেরি। কিন্তু তাঁকে তো শুধু প্রপিতামহ গ্রেগরি বলে ডাকা যাবে না, সংক্ষিপ্ত একটা নাম দেওয়া উচিত। অনেক ভেবে রোজমেরি ঠিক করল তাঁর পূর্বপুরুষকে শুধু গ্রেগরি নামেই ডাকবে। কারণ গ্রেগরি তার কাছে রক্ত মাংসের মানুষের মতোই বাস্তব মনে হচ্ছে। যেন ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু।
রাতের বেলা, ঘুমুবার সময় বিচিত্র এক অনুভূতি জাগল রোজমেরির। আগে আলো নিভিয়ে অন্ধকারে ঘুমাতে তার খুব ভয় লাগত। মাকে অবশ্য এ কথা কখনো বলেনি রোজি মা হাসাহাসি করবে বলে। সত্যি তো, দশ বছরের একটা মেয়ে আলো নিভিয়ে ঘুমাতে ভয় পায় শুনলে সবাই হাসবে।
তবে আজ ভয় লাগছে না। মাথার ওপর গ্রেগরির ছবি আছে বলেই হয়তো। যে লোক যুদ্ধে সেনাপতিত্ব করতে পারেন তিনি সহজেই তার আত্মীয়, ছোট একটি মেয়ের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারবেন। কাজেই রোজমেরির ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বরং, ওকে আরও সাহসী হতে হবে। ভয় পেলে নিজের পূর্বপুরুষকে লজ্জায় ফেলে দেওয়া হবে।
বিছানায় কিছুক্ষণ গড়াগড়ি দিয়ে গায়ের চাদর সরিয়ে নিঃশব্দে নেমে পড়ল রোজমেরি, দাঁড়াল জানালার সামনে, পর্দা সরাল। এরকম কাজ আগে কখনো করেনি সে। জানালা সব সময় বন্ধ রেখেছে রোজি। কারণ চাঁদের আলো পড়ে দেয়ালে ভ্যাম্পায়ার আকৃতির যেসব নকশা তৈরি করে, রোজমেরি খুবই ভয় পায়।
জানালা থেকে সরে এল রোজমেরি, তাকাল পোর্ট্রেটের দিকে। গ্রেগরির চোখ ওকে অনুসরণ করছে। বিছানায় লাফ দিল রোজমেরি, হাসল পূর্বপুরুষের দিকে তাকিয়ে।
গুড নাইট, গ্রেগরি, বলল সে। তারপর বিন্দুমাত্র ইতস্তত না করে সুইচ টিপে আলো নেভাল রোজমেরি, একটু পরে ঘুমিয়ে পড়ল।
সেরাতে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখল রোজমেরি। তার স্বপ্নে জ্যান্ত হয়ে ছবির ফ্রেম থেকে নেমে এলেন গ্রেগরি। রোজমেরি দেখল দৃশ্যপট বদলে গেছে। সে চলে এসেছে ক্রিমিয়ার যুদ্ধের সেই সময়ে। গ্রেগরি বিশাল তরবারি নিয়ে বীর বিক্রমে শত্রুর বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। কিন্তু বেশিক্ষণ লড়াই করা সম্ভব হলো না। আহত হয়ে পড়ে গেলেন মাটিতে। রোজমেরি ছুটে গেল তাঁর কাছে। তিনি মৃত্যুর আগে বলে গেলেন, রোজমেরি, সাহস রাখো। ভয়ের কিছু নেই।
ঘুম ভেঙে গেল রোজমেরির। স্বপ্নটাকে তার খুব বাস্তব মনে হতে লাগল। ভয়ে ভয়ে সে পোর্ট্রেটের দিকে তাকাল। ভেবেছে ওখানে গ্রেগরির ছবির বদলে রাশান। কোনো সৈনিককে দেখবে।
না, গ্রেগরি আছেন আগের জায়গাতেই। শান্ত, স্থির ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে।
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল রোজমেরি। তুমি তা হলে এখনো ওখানে আছ। বেশ।
সাহস রাখো। পোর্ট্রেটকে যেন বলতে শুনল রোজমেরি।
স্কুলের কাউকে গ্রেগরি সম্পর্কে কিছু বলল না রোজমেরি। ব্যাপারটা গোপন থাকল। তবে গ্রেগরি তার মনে সত্যি সাহস এনে দিলেন। একটা ছোট্ট ঘটনাই এর প্রমাণ।
রোজমেরিদের স্কুলে একটি খেলা খেলে সবাই। প্রথমে বৃত্তাকারে দাঁড়ায় মেয়েরা, একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মাঝখানে, ঘোরাতে থাকে একটি রশি, রশির অন্য পাশ চাপা থাকে পাথর দিয়ে। এখন ঘুরন্ত ওই রশি এক লাফে পার হয়ে যেতে হবে। টাইমিংটা এক্ষেত্রে নিখুঁত হওয়া চাই। আর এখানটায় রোজমেরির গড়বড় হয়ে যায়। সে রশি পার হতে গিয়ে প্রতিবার আছাড় খেয়েছে। আর ক্লাসসুদ্ধ মেয়ে হেসে উঠেছে, সেইসাথে পিটি টিচার মিস ব্রিগসের কঠিন ধমক তো আছেই।
তবে এবার ঠিকঠিক রশি পার হয়ে গেল রোজমেরি। সে যখন লাফ দেবে ঠিক করেছে, ঠিক সেই মুহূর্তে গ্রেগরির গলা শুনতে পেল, ওকে অভয় দিচ্ছেন তিনি, মাথা ঠান্ডা রাখতে বলছেন। তারপর বলে উঠলেন : এখন! লাফাও!
লাফ দিল রোজমেরি এবং চমৎকারভাবে রশি পার হয়ে গেল। মিস ব্রিগস স্বীকার করতে বাধ্য হলেন আগের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে রোজমেরির। কিন্তু রোজমেরি তো জানে কৃতিত্বটা আসলে কার।
সেদিন স্কুল লাইব্রেরিতে গিয়ে ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ওপর বই খোঁজ করল রোজমেরি।
অত কঠিন বই তুমি কিছুই বুঝতে পারবে না, খুকি, লাইব্রেরিয়ান বলল ওকে। সত্যি পড়বে?
মাথা দোলাল রোজি। জি, কারণ আমাদের পরিবারের একজন ওই যুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। তাঁর ছবি আছে আমার কাছে। আমি যুদ্ধটি সম্পর্কে জানতে চাই।
টিফিন পিরিয়ডে খেলার মাঠে বসে ইঙ্কারম্যানের যুদ্ধ সম্পর্কিত লেখা সমস্ত তথ্য গোগ্রাসে গিলল রোজমেরি। শিউরে উঠল যুদ্ধের ভয়াবহতার কথা জেনে। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের কথাও আছে, উনি যুদ্ধাহত মানুষের সেবা করেছেন। গ্রেগরির সাথে কি ফ্লোরেন্সের সাক্ষাৎ হয়েছিল, ভাবল সে।
রোজমেরি ঠিক করল বড় হয়ে সে নার্স হবে, মানুষের সেবা করবে। কল্পনায় দেখল হাসপাতালের একটি ওয়ার্ডে সে হেঁটে যাচ্ছে, বিছানায় শুয়ে থাকা রোগীদের কুশল জিজ্ঞেস করছে। তারপর দেখল সম্পূর্ণ সাদা পোশাকে সে চার্চে যাচ্ছে, সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে তরবারি হাতে লম্বা এক সৈনিক, অপেক্ষা করছে তার জন্য।
বই পোকা! খেলার মাঠে এক মেয়ে ঠাট্টা করে ডাকল রোজমেরিকে। সাথে সাথে কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে এল রোজি। বইয়ের আরেকটি পাতা ওল্টাতেই গ্রেগরির নাম চোখে পড়ল তার। তার পূর্বপুরুষের নাম সত্যি আছে ইতিহাস বইতে! ক্যাপ্টেন গ্রেগরি হ্যাঁসকস। আবার কল্পনার ডানায় ভর করল। রোজমেরি। দেখল টিভিতে কুইজ প্রতিযোগিতা হচ্ছে। প্রশ্নকর্তা জিজ্ঞেস করলেন, ক্যাপ্টেন গ্রেগরি হ্যাঁসকস কে ছিলেন?