আমার সমবয়সী কোনো বন্ধুর দরকার নেই। আমার বন্ধু আমি পেয়ে গেছি।
বাহ্, চমৎকার। তবে তোমার বন্ধু হওয়ার জন্য আমার এবং ফ্রেডেরিকের বয়সটা একটু বেশিই–
আমি আপনাদের কথা বলিনি কিন্তু। তাহলে? কে?
সেসিলি তার কথা শেষ করার আগেই মেয়েটি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ওর খিলখিল হাসির শব্দ শুনতে পেল সেসিলি হলঘর থেকে যাওয়ার সময়।
.
সেই রাতে খাওয়াদাওয়া শেষে ফ্রেডেরিক এবং সেসিলি হলঘরে ফায়ার প্লেসের সামনে বসেছিল। ইসোবেল দোতলায় নিজের ঘরে চলে গেছে। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চুপচাপ। কথা বলতে চাইছে কিন্তু বলার মতো হয়তো কিছু খুঁজে পাচ্ছে না।
অবশেষে সেসিলিই ভঙ্গ করল নীরবতা। নিচু গলায় কথা বলছে। স্বর উঁচু করতে যেন ভয় পাচ্ছে।
তোমার চেহারা এমন শুকনো লাগছে কেন, ফ্রেডেরিক? কী হয়েছে? নতুন বইটি ঠিকঠাক লেখা হচ্ছে না?
ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা মুশকিল, সেসিলি। কথাটা হয়তো বোকার মতোই শোনাবে তবে সত্য হলো এই যে ইসোবেল আমাদের বাড়িতে আসার পর থেকে আমি এক কলমও লিখতে পারছি না।
কিন্তু ও তো তোমাকে কোনো বিরক্ত করে না, করে কি? ও কোনো শব্দই করে না। মাঝেমধ্যে ভাবি মেয়েটা বড্ড বেশি চুপচাপ।
না, না। ও আমাকে বিরক্ত করছে না। ব্যাপারটা ইসোবেলকে নিয়ে নয় থেমে গেল সে। চেহারা দেখে মনে হলো ভয় পেয়েছে।
বলো, ফ্রেডেরিক। প্লিজ, বলে ফেলল।
তুমি তো জানোই আমি একা একা লিখি। ঘর একদম নীরব না থাকলে আমি লিখতে পারি না। আমি আমার টেবিলে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লিখে যেতে পারি।
সে তো আমি জানিই। তোমার বিশাল লাইব্রেরি ঘরখানার তো কোনোরকম পরিবর্তন করা হয়নি। তুমি প্রতিদিন সকালে নাশতা সেরে ওখানে লিখতে যাও এবং লাঞ্চ পর্যন্ত টানা লেখো।
হ্যাঁ। তবে কয়েকদিন ধরে কিছু লিখতে পারছি না। আমি বারবার চেষ্টা করেছি লিখব বলে। কিন্তু এক কলমও এগোতে পারিনি। কারণ ওই ঘরে আমি একা নই!
তুমি একা নও! এ কথার মানে কী, ফ্রেডেরিক? তুমি লেখার সময় তো আমি ওই ঘরের ধারেকাছেও যাই না। ইসোবেলও না। যদি যায় তাহলে মানা করে দিও। তুমি বলতে না পারলে আমি ওকে বারণ করব।
না, না। ও আমার ঘরে কখনো যায় না। তবে আমি লেখার টেবিলে বসার পরে একটি গলা শুনতে পাই। নারীকণ্ঠ-বুড়ো মানুষের খনখনে গলা। সে যেন আমাকে কিছু বলতে চায়। কিন্তু আমি তার কথা বুঝতে পারি না। ঘরটি তখন আমার কাছে অদ্ভুত লাগে। মনে হয় এ ঘরটি আমার নয়। টেবিলটি আমার নয়। চেয়ারটি আমার নয়। লাইব্রেরির কোনো কিছুই আমার নয়।
ফ্রেডেরিক! থামো! সেসিলির গলা চড়ল-আমাকে তুমি ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। তোমার বিশ্রাম দরকার-ছুটি কাটানো প্রয়োজন। আমরা
থেমে গেল সে। একটা ছায়া পড়েছে মুখের ওপর। মুখ তুলে চাইল সেসিলি। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে ইসোবেল। তুমি কি চাও? আর এত নিশব্দে হাঁটাচলা করো কেন? ভয় রাগিয়ে তুলেছে সেসিলিকে।
আমি সবসময়ই নিশব্দে হাঁটাচলা করি, জবাব দিল মেয়েটি। হাসছে যেন ওর দিকে তাকিয়ে। আপনারা তো চান বাড়িটি সবসময় চুপচাপ থাকবে। আমি চেষ্টা করি আপনারা যাতে বিরক্ত না হন। আমার খুব তেষ্টা পেয়েছিল। তাই নিচে এসেছিলাম এক গ্লাস পানি খেতে।
তাহলে পানি খেয়ে নিজের রুমে চলে যাও।
জি, মিসেস বিশার।
একটু পরে সে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল। হাতের গ্লাসটি টেবিলে রেখে ওদের দুজনের মাঝখানে এসে দাঁড়াল।
আপনাদের কেউই নিশ্চয় আমার দাদিমাকে দেখেননি, দেখেছেন?
আমি দেখিনি, জবাব দিল ফ্রেডেরিক। আমার স্ত্রীও দেখেছে বলে মনে হয় না। তোমরা যখন এ বাড়িতে থাকতে তখন আমরা এখানে আসিনি।
আমার ছোটবেলায় দাদিমা এ বাড়িতে আমাদের সঙ্গে থাকতেন। তাঁকে আমি খুব ভালোবাসতাম। আমাকে তিনি অনেক গল্প বলতেন। পুরোনো দিনের গল্প। দাদিমা এখানেই মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পরে আমার বাবা সমস্ত টাকা পয়সা খুইয়ে ফেলে। তারপর আপনারা আমাদের বাড়িটি কিনে নেন।
শুনে খুব খারাপ লাগল, ইসোবেল। তোমার জন্য আমাদের মায়াই হচ্ছে, তবে–
আমার জন্য মায়া করতে হবে না। আমি তো এখন ফিরেই এসেছি। দাদিমা আমাকে বলেছেন বাড়িটি আবার আমার হবে।
ইসোবেল ওদের দিকে তাকিয়ে আবার হাসল। তবে সবাই দু-এক মিনিট নিশ্চুপ থামল। শেষে সে বলল, আপনার লাইব্রেরি ঘরটি কি আমাকে একটু ব্যবহার করতে দেবেন, মি. ফ্রবিশার? ওটা ছিল আমার দাদিমার স্পেশাল রুম। আমি ছাড়া অন্য কেউ ওই ঘরটিতে ঢুকলে তিনি রেগে যেতেন। আমাকে তিনি চেয়ারে বসিয়ে আমার সঙ্গে গল্প করতেন। তবে আমি ওই ঘরে গেলেও আপনাকে কোনোরকম বিরক্ত করব না। আমি চুপচাপ থাকব। দাদিমা তখন আমাকে গল্প বলতেন আমি চুপচাপ শুনতাম।
তবে… আমার মনে হয় না… ফ্রেডেরিক তার বাক্য অসমাপ্ত রেখে দিল। আড়চোখে তাকাল স্ত্রীর দিকে। সেসিলি হাত দিয়ে ঢেকে রেখেছে মুখ ।
তবে এক্ষুনি আপনাকে সিদ্ধান্ত জানাতে হবে না। কাল সকালে বললেও হবে। আমি এখন ঘুমাতে যাব। ওহ্, বলতে ভুলে গেছি আমার কাছে দাদিমার একখানা ছবি আছে। নিচে নামার সময় নিয়ে এসেছি। এই যে দেখুন, মিসেস ফ্রবিশার।
সে সেসিলির হাতে ছবিটি খুঁজে দিল। ওটার দিকে তাকিয়ে মুখ সাদা হয়ে গেল সেসিলির। ভয়ার্ত একটা চিৎকার বেরুল গলা চিরে। ছবির মানুষটিকে দেখেই চিনতে পেরেছে। এ বৃদ্ধাকেই সে স্বপ্নে দেখেছে।