নিচতলায় আসার পরে হঠাৎ ওর কেমন অসুস্থ বোধ হতে লাগল। বুকের মধ্যে দপদপ করছে কলজে, মাথাটায় কেমন ব্যথা ব্যথা লাগছে। অগ্নিকুণ্ডের পাশে একটি চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল সেসিলি।
সেসিলি ফ্রবিশার, নিজেকে বলল ও। তুমি একটা নির্বোধ মহিলা। তুমি নার্ভাস হয়ে আছ। নার্ভাস কারণ ষোড়শী একটি মেয়ে তোমাদের সঙ্গে থাকতে আসছে। কী বোকা তুমি! তুমি কেন ভয় পাচ্ছ? তোমার একজন চমৎকার স্বামী আছে যে প্রচুর টাকা আয় করে। সে ভালো ভালো বই লেখে এবং হাজার হাজার পাঠক তা কেনে। তুমি একজন সুখী মানুষ। এখন চোখ বুজে ইসোবেল না আসা পর্যন্ত বিশ্রাম নাও।
আগুনের উত্তাপ এবং আরামদায়ক চেয়ারের নরম গদি একটু পরেই ওর চোখে ঘুম এনে দিল। ঘুমের মধ্যে ও একটা স্বপ্ন দেখল। সে হলঘর দেখতে পেল। দেখল চেয়ারে বসে ও ঘুমাচ্ছে। তারপর দেখল লাইব্রেরি ঘরের দরজা খুলে গেছে এবং এক বৃদ্ধা বেরিয়ে এল ওই ঘর থেকে। মহিলার পরনে লম্বা, কালো একটি ড্রেস। মাথার চুল পেকে সাদা। সে হেঁটে এগোল হলঘরে। দাঁড়াল ফায়ারপ্লেসের সামনে। ঘুরল ঘুমন্ত মহিলাটি অর্থাৎ সেসিলির দিকে। সেসিলি বুঝতে পারল তার অদ্ভুত অতিথিটি এখন কথা বলবে।
না! আর্তনাদ করে উঠল সেসিলি। বোলো না! আমার সঙ্গে কথা বলো! আমি তোমার কথা শুনতে চাই না!
নিজের চিল্কারের শব্দে জেগে গেল সেসিলি। লাফ মেরে খাড়া হলো। হলঘর শূন্য। তারপর সদর দরজা খুলে গেল এবং একটি মেয়ের গলার স্বর ভেসে এল।
আমি রাস্তা চিনি। এখানে আমি একসময় থাকতাম, জানেনই তো। অন্ধকারেও এ বাড়ির আনাচেকানাচে আমি হেঁটে বেড়াতে পারব।
ফ্রেডেরিক এবং ইসোবেল এগিয়ে গেল সেসিলির দিকে। ফ্রেডেরিকের হাতে মেয়েটির সুটকেস। তার মুখ হাসি হাসি।
আমরা এসে গেছি, সেসিলি। ট্রেন আসতে অনেক দেরি হলো। আর বাইরেও ভীষণ ঠান্ডা পড়েছে আজ। ইসোবেলকে ওর রুমে নিয়ে যাও। আমি ওর সুটকেস নিয়ে যাচ্ছি। তারপর একসঙ্গে ডিনার করব। বেশ খিদে পেয়েছে। ইসাবেলেরও নিশ্চয় খিদে লেগেছে।
ইসোবেল বেশ লম্বা, গায়ের রঙ তামাটে, রোগাপাতলা। চোখজোড়া উজ্জ্বল, ঝকঝকে। ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে। বোধ করি উত্তেজিত।
মিসেস ফ্রবিশার, বলল সে। আমাকে আপনারা থাকতে দিচ্ছেন বলে আমি কৃতজ্ঞ। আমি আবার আমার বাড়িতে ফিরে এসেছি।
মেয়েটির বলার ভঙ্গি নম্র। জবাবে কিছু বলতে গিয়েও মুখে কোনো কথা জোগাল না সেসিলির। তার কেমন অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। নিজের বাড়িতেই অদ্ভুত লাগছে। বাড়িতে মেয়েটি মেহমান নাকি সে?
ইসোবেল হলঘরে একবার চোখ বুলাল। একদম বদলে গেছে সবকিছু। মন্তব্য করল সে। আপনি বাড়ির অনেক রদবদল ঘটিয়েছেন।
হ্যাঁ, আমরা– সেসিলিকে কথা শেষ করতে দিল না ইসোবেল। হ্যাঁ, বাড়িতে অনেক আলো এবং উত্তাপ। আমরা যখন এ বাড়িতে থাকতাম তখন হলঘরে কোনো ফায়ারপ্লেস ছিল না। আমরা সেই খরচটা চালাতে পারিনি। আপনাদের অনেক টাকা পয়সা, না?
না, বলল সেসিলি-নরম গলায় বলার চেষ্টা করছে–না, ইসাবেল, আমাদের অনেক টাকা পয়সা নেই। আমা
আমার জন্য কোন ঘরটি রেখেছেন? আবারও সে সেসিলির কথায় বাধা দিল।
তুমি বড় বেডরুমটিতে থাকবে। ওখান থেকে বাগান দেখা যায়। ভাবলাম তোমার হয়তো ওই ঘরটাই পছন্দ–
হ্যাঁ, ধন্যবাদ। দোতলার সামনের দিকের ওই বেডরুমটিতেই আমি সবসময় থাকতাম। আমার সঙ্গে আসতে হবে না। আমি ঘরটি চিনি।
সে দৌড়ে উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে। ফ্রেডেরিক হাতে সুটকেস নিয়ে মন্থর গতিতে গেল ওর পেছন পেছন। সেসিলি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল ওদের প্রস্থান।
ফ্রেডেরিক হলঘরে ফিরে এসে দেখে তার স্ত্রী ফায়ারপ্লেসের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেসিলির কাছে এলে সে ঘুরে দাঁড়াল।
আমি একটা মস্ত ভুল করে ফেললাম, ফ্রেডেরিক।
ওহ্, এত তাড়াতাড়ি এ কথা কী করে বলছ তুমি? আমরা চুপচাপ, নিস্তরঙ্গ জীবনযাপনে অভ্যস্ত। সব ঠিক হয়ে যাবে।
স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেও নার্ভাস লাগছিল ফ্রেডেরিকের। তার গলার স্বর এমন নামানো যে স্বামীর কথা প্রায় শুনতেই পেল না সেসিলি।
এক সপ্তাহ পার হয়ে গেল। সেসিলি আগের মতো আর হতাশ বোধ করছে না। হয়তো ইসোবেলকে এ বাড়িতে এনে সে কোনো ভুল করেনি। ইসোবেল তেমন একটা ঝামেলা করছে না। সে সেসিলিকে রান্নাবান্নায় সাহায্য করে। খাওয়ার সময় ওদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে এবং ভদ্রতা বজায় রেখে। সে একটু আগে আগেই ঘুমাতে যায় এবং বেশিরভাগ সময় দোতলায় নিজের কামরাতেই থাকে। নিজের নতুন জীবন নিয়ে ওকে খুশিই মনে হচ্ছে।
আমার মনে হয় তুমি খুব একাকী বোধ করছ, একদিন রান্নাঘরে বসে ইসোবেলকে বলল সেসিলি। লাঞ্চ প্রায় রেডি। ছুটি শেষ হলেই তুমি নতুন স্কুলে যাবে এবং সেখানে সমবয়সী অনেক নতুন বন্ধুবান্ধব পাবে। এত বড় বাড়িতে তোমার এত কিশোরী মেয়ের একা একা লাগাটাই স্বাভাবিক।
একা! ইসোবেল হাসল সেসিলির দিকে তাকিয়ে। আমি একা নই, মিসেস ফ্রবিশার। এখানে একা থাকার কোনো অবকাশ নেই।
তোমার কথা শুনে খুশি হলাম, বলল সেসিলি। হয়তো ইসাবেল ওদেরকে পছন্দ করতে শুরু করেছে।
কিন্তু তোমার নিজের বয়সী বন্ধুবান্ধব দরকার। স্কুলে বন্ধু হলে তুমি তাদেরকে বাসায় দাওয়াত দিতে পারবে।