নালাটার কাছে পৌঁছে একবার পেছনে তাকালাম৷ আমার আসার সুঁড়িপথটা ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে৷ বুনো ঘাসের ডগাগুলো ফণা তোলা সাপের মতো দুলছিল৷ কাউকে ছোবল মারবে নাকি?
মাথাটা সবে ঘুরিয়েছি, এমন সময় শাল, সেগুন আর গামার গাছের দুর্ভেদ্য পাঁচিলের মধ্য দিয়ে হঠাৎই একটা দমকা হাওয়া বয়ে গেল৷ আমার মনে হল কেউ যেন কান্নার সুরে ফিসফিস করে বলে উঠল, ফিরে আয়, ফিরে আয়…এখনও সময় আছে…ফিরে আয়…
চোখটা একবার বন্ধ করেই ফের খুললাম আমি৷ কী সব আজেবাজে ভাবছি! গোলকপুষ্প খুঁজে পাওয়ার উত্তেজনায় মাথাটা আমার খারাপ হয়ে গেল নাকি?
জাঙ্গল নাইফটা হাতে নিয়ে নালাটায় নামলাম৷ সঙ্গে সঙ্গে টের পেলাম যে শুকনো নালার ঘাসে বাতাসের একটা দমকা দীর্ঘশ্বাস খেলে গেল৷
আর তারপরেই সব চুপ!
চুপ মানে একদম চুপ৷ হঠাৎ করেই কে যেন বাতাসের টুঁটি টিপে ধরেছে, আশ্বিনের ঝিরিঝিরি বাতাস একেবারেই উধাও৷ জঙ্গলের আওয়াজটা কমে আসতে আসতে একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল৷
বুকসমান উঁচু ঘাস ঠেলে নালাটা পেরোতে সময় লাগল মিনিট তিনেক৷ হাঁচোড়পাঁচোড় করে ওপরে উঠে একবার ঘুরে দাঁড়ালাম৷ ব্যাপারটা কী? সব কিছু এরকম ঠান্ডা মেরে গেল কেন?
কই কোথাও কিছু নেই তো! সব স্বাভাবিক৷ শুধু ওই একটাই ব্যাপার, জঙ্গলের পাখির ডাক বা অন্য কোনো আওয়াজ নেই, আর বাতাসে একটা বিষণ্ণ গম্ভীর ভাব ছেয়ে আছে৷
ব্যাপারটা কী? এদিকটায় পাখি-টাখি বা অন্যান্য জন্তুজানোয়ার নেই নাকি? এরকম তো হওয়ার কথা নয়!
আমার ভাবনাটা যে ভুল সেটা টের পেলাম সঙ্গে সঙ্গেই৷
আমার ঠিক সামনে ছিল একটা পুরোনো শ্যাওলা ধরা অগুরু গাছ৷ সেদিকে এক পা এগোতেই দেখি কোথা থেকে একটা কাক উড়ে এসে বসল তার ডালে৷
শুধু বসল৷
ডাকল না৷
তার দৃষ্টি সোজা আমার দিকেই৷
লক্ষ করলাম কাকটার চোখদুটো কালো নয়৷ লাল, হলদেটে লাল৷
কাকটাকে উপেক্ষা করেই পরের পা ফেললাম৷ এবার ডানদিকের গামার গাছের ডালে উড়ে এসে বসল আরেকটা কাক৷ ঠিক আগেরটার মতোই৷ এও ডাকল না৷ হলদেটে লাল চোখ মেলে তাকিয়ে রইল আমার দিকে৷ একটু আশ্চর্য হলাম৷ এ আবার কীরকমের কাক?
পরের পা ফেললাম৷ এবার বাঁদিকের শিশুগাছের ডালে উড়ে এসে বসল আরেকটা কাক৷ সেও আগের দুটোর মতোই হলদেটে লাল চোখ মেলে চেয়ে রইল আমার দিকে৷
এবার একটা অদ্ভুত জিনিস শুরু হল৷ এক পা এক পা করে এগোচ্ছি, আর দেখছি আশেপাশের প্রতিটা গাছের ডালে এক একটা করে কাক উড়ে এসে বসছে৷ তাদের প্রত্যেকের দৃষ্টি আমার দিকে, তাদের প্রত্যেকের চোখের রং এক৷
রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, একটা পথের আভাস পাওয়া যাচ্ছে না? মনে হল সেটা এই সাম্প্রতিক কালেই তৈরি হয়েছে৷ তার মানে কি অলরেডি অন্য কেউ কাউরীবুড়ির মন্দিরের খোঁজ পেয়ে গেছে? অর্থাৎ আমার একজন কম্পিটিটর ইতিমধ্যেই নেমে পড়েছে বাজারে? এত দূর এসে তরী ডুববে নাকি?
ব্যাপারটা মাথায় আসতেই মনে একটা মরিয়া সাহস ফিরে পেলাম৷ জাঙ্গল নাইফটা বাগিয়ে এগিয়ে পড়লাম সেই রাস্তা ধরে৷
আজ এতদিন বাদেও সেই দুপুরটার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে৷ সম্পূর্ণ অচেনা-অজানা একটা জঙ্গল৷ একটা ঝিমধরা নিঝুম নিস্তব্ধতা চারিদিকে ছেয়ে আছে৷ তার মধ্য দিয়ে আমি একা একটা জাঙ্গল নাইফ হাতে ডালপালা ছাঁটতে ছাঁটতে এগোচ্ছি৷
একটা কথা অবশ্য ভুল হল৷ আমি একা নই৷ ওরাও আছে৷
আমি খেয়াল করছিলাম যে আমার এগোবার সঙ্গে সঙ্গে সেই কাকেদের ঝাঁকও আমার সঙ্গে সঙ্গে এই ডাল, ওই ডাল করে এগোচ্ছিল৷ তাদের কেউ একবারও ডাকছে না৷ শুধু আমার পথের আশেপাশের কোনো গাছের ডালে একটু একটু করে উড়ে গিয়ে বসছে আর আমার দিকে ফিরে সেই ঠান্ডা হলদেটে লাল চোখে তাকিয়ে আছে৷
এইভাবে মিনিট দশ-পনেরো এগোনোর পর হঠাৎ করেই একটা ফাঁকা জায়গায় এসে পৌঁছোলাম৷ জায়গাটা একটা চাতাল মতো৷ খানিকটা গোলমতো ফাঁকা জায়গা, যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তার ঠিক উলটো দিকে বেশ কয়েকটা নিমগাছ একসঙ্গে জড়ো হয়ে একটা বিশাল চাঁদোয়া মতো বানিয়েছে৷ আর তার ঠিক নীচে পাথরের তৈরি পুরোনো একটা মন্দির৷
কাউরীবুড়ির মন্দির!!
এতক্ষণের পরিশ্রমে আর উত্তেজনায় দরদর করে ঘামছিলাম৷ ওখানেই ধুপ করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম৷ মাথাটা নীচু করতেই বুকের ধড়াস ধড়াস আওয়াজটা নিজের কানেই দ্রিমিদ্রিমি হয়ে বেজে উঠল৷ আর কয়েকটা মুহূর্ত মাত্র৷ তার পরেই হয়তো সাত রাজার ধন এক মানিক আমার হাতে!
মিনিটখানেক ওইভাবে বসে থাকার পর মাথা তুলে উঠে দাঁড়ালাম৷ বেল্টটা টাইট করে বেঁধে আর জাঙ্গল নাইফটা খাপে ঢুকিয়ে নেমে পড়লাম চাতালে৷ তারপর লম্বা লম্বা পায়ে জায়গাটা অতিক্রম করে মন্দিরটার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালাম৷
পাথরের মন্দির, আকারে বেশ বড়৷ আমাদের পরিচিত ভারতীয় একচালা বা দোচালা মন্দির থেকে বেশ আলাদা৷ আদল অনেকটা তিব্বতি বা চিনা মন্দিরের মতো৷ মন্দিরের সারা গায়ে দক্ষ হাতে পাথর কুঁদে অপূর্ব অলংকরণ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে৷ মন্দিরের ঠিক সামনে একটা হাড়িকাঠও নজরে এল৷ মানে এককালে বলিদানের ব্যবস্থাও ছিল নিশ্চয়ই৷ নরবলিও হত কি?
ধীর পায়ে মন্দিরের ভেতরে গিয়ে উঠলাম৷ ওঠার আগে হান্টিং বুটটা খুলে রাখতে ভুললাম না যদিও৷ হাজার হোক এত বছরের সংস্কার৷ তা ছাড়া আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছিল যে এই মন্দির এখনও জাগ্রত, এখানে শ্রদ্ধাবনত ভাবে, মাথা নীচু করেই ঢুকতে হবে৷