এই পর্যন্ত বলে আঁচলে মুখ ঢাকলেন কাকিমা, ‘‘ওই এক কথা বলে সেই যে ঘরে ঢুকল, তারপর থেকেই মেয়েটা কেমন যেন হয়ে গেছে৷ যতই জিজ্ঞেস করি, কী হয়েছে মা, কেন এখানে চলে এলি সে নিয়ে কিছু বল আমাদের! বনিবনা হচ্ছে না? অনির্বাণের সঙ্গে অন্য কোনো মেয়ের সম্পর্ক আছে? টাকাপয়সা বা অন্য কোনো কিছু চাইছে? অথবা অন্য কোনো অত্যাচার যা আমাদের মুখ ফুটে বলতে পারছিস না? কিন্তু মেয়ে কিছুই বলছে না বাবা৷’’
কাকুদের উদ্বেগের কারণটা বুঝলাম৷ হওয়ারই কথা, হাজার হোক একমাত্র মেয়ে, ধুমধামের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন৷ তার মাসখানেকের মধ্যেই যদি তাকে তার নিজের সাজানো সংসার ছেড়ে ফিরে আসতে হয় তাহলে চিন্তার কারণ থাকে বই কি!
‘‘আপনারা অনির্বাণের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেননি?’’ আমি প্রশ্ন করেছিলাম৷
‘‘করেছিলাম বই কি! তাকে ফোন করে কথা বলার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি৷ কিন্তু অর্ধেক সময় হয় তার অফিস বা বাড়ির ল্যান্ডলাইন কাজ করে না, বা করলেও কেউ ফোন তোলে না৷’’
‘‘তারপর?’’
‘‘তারপর’’, এই বলে কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে চুপ রইলেন কাকিমা৷ তারপর মুখ তুলে বললেন, ‘‘আমরা গেছিলাম ডিব্রুগড়ে৷ কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও অনির্বাণের দেখা পাইনি৷’’
‘‘আর ওদের বাড়ি? সদিয়াতে যাননি?’’
‘‘গেছিলাম বই কি!’’
‘‘তাহলে?’’
‘‘দরজা বন্ধ ছিল৷ আমাদের অনেক কড়া নাড়াতেও কেউ দরজা খোলেনি৷’’
শুনে পুরো ব্যাপারটাই বেশ আশ্চর্যজনক লাগল৷ তখনও অবধি অবিবাহিত থাকলেও চেনাপরিচিতদের মধ্যে বেশ কিছু সাংসারিক অশান্তি, পারস্পরিক মনোমালিন্য, এমনকি ডিভোর্স হতেও দেখেছি৷ সব জায়গায় দেখেছি যে ঘুরেফিরে সেই কয়েকটা চেনা ইস্যুই বারবার ফিরে আসে৷ কিন্তু এখানে কেসটা বেশ আশ্চর্যের৷ এমন কী ঘটেছে যে মাধুরী কাউকে, এমনকি তার মা-বাবাকেও জানাতে পারছে না?
‘‘সেই থেকে মেয়েটা শুকনো মুখে ঘুরে বেড়ায় বাবা৷ চোখের সামনে দিন দিন কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে৷ ভালো করে খায় না, গান শোনে না, হাসি-ঠাট্টা নেই৷ মা হয়ে কী করে সহ্য করি বলো’’, চোখে আঁচল চাপা দিলেন কাকিমা৷
কাকুও দেখি মাথা নীচু করে বসে আছেন৷ তারপর মুখ তুলে বললেন, ‘‘আমরা বেশ কিছু সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়েছিলাম, বুঝলে৷ কিন্তু কেউই বিশেষ কিছু করে উঠতে পারেননি৷ অন্তত যদি ওর এই ডিপ্রেশনটা কাটে, মুখ ফুটে আমাদের জানায় যে কী হয়েছে, তাহলেও কিছু একটা ব্যবস্থা করতে পারি৷ চার-পাঁচ মাস হয়ে গেল মেয়ে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে না৷ এদিকে আত্মীয়স্বজন আছে, পাড়াপড়শি আছে, তাদেরকে আর কতদিনই বা মিথ্যে বলে ঠেকিয়ে রাখি বলো? ইতিমধ্যেই এদিক-ওদিক কানাকানি শুরু হয়েছে৷ আমাদের মান-সম্মানেরও তো একটা ব্যাপার আছে৷’’
তখন আমার অল্প বয়েস৷ তা ছাড়া রহস্যজনক ব্যাপারের দিকে চিরকালই আমার একটা আলাদা আগ্রহ ছিল৷ মনস্থির করে নিলাম, এই রহস্যের শেষ না দেখে আমি ছাড়ব না৷ তা ছাড়া কৃতজ্ঞতাবোধ বলেও তো একটা ব্যাপার আছে৷
কথাটা কাকুকে জানিয়ে দিলাম৷ এও বললাম যে কাল বিকেলে আমি একবার মাধুরীর সঙ্গে আলাদা করে কথা বলতে চাই৷
* * * *
পরের দিন সকাল এগারোটা নাগাদ যখন আমি বাড়ি থেকে বেরোলাম তখনই মাথার ওপর রোদ্দুর বেশ চড়া৷ পিঠে একটা ছোট রুকস্যাক, তাতে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্তর৷ কোমরে একটা জাঙ্গল নাইফ, একটা পয়েন্ট টু টু বোরের রিভলভার আর পাউচ ব্যাগে আসাহি ক্যামেরাটা৷ এদিকে আবার বিকেলের দিকে বেশ ঠান্ডা পড়ে৷ তাই রুকস্যাকে একটা সোয়েটারও আছে৷ পরনে জংলা ছাপের টাইট টিশার্ট আর কর্ডরয়ের ট্রাউজার, পায়ে মোটা হিলের হান্টিং বুট৷
মংকুকে ইচ্ছে করেই সঙ্গে নিইনি৷ জানতাম যে যদি ওকে জানাই কোথায় যাচ্ছি, তাহলে আমার যাওয়াটা ভেস্তে যাওয়া অবধারিত৷ আমার মন বলছিল ওই কাউরীবুড়ির মন্দিরই আমার অভীষ্ট লক্ষ্য৷ ওখানেই গোলকপুষ্পর খোঁজ পাব৷
তবে কাজটা যে প্রভূত ঝুঁকির সে নিয়ে সন্দেহ নেই৷ আসামের জঙ্গলের মতো বিপদসংকুল জায়গা কমই আছে৷ লেপার্ড বা পাইথনের কথা ছেড়েই দিলাম, কখন যে ঘাসের জঙ্গল থেকে শিং উঁচিয়ে তেড়ে আসবে হিংস্রে বুনো মোষ, বা হিলহিলে মাথা তুলে দাঁড়াবে ব্যান্ডেড ক্রেইট, সেসব সাধারণ মানুষের ধারণার বাইরে৷ এতদিন এসব মংকুই সামলাত৷ কোন রাস্তা নিরাপদ, কোন পথে গেলে বুনো হাতির দলের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ হওয়ার সম্ভাবনা কম, কোথায় গেলে নিরাপদ দূরত্ব থেকে দুটো আঠেরো ফুট লম্বা কিং কোবরার সংসারযাপনের ছবি তুলতে পারব, সেসব ওর একেবারে নখদর্পণে ছিল৷
কিন্তু আজ আমি একা৷
রাস্তা এই ক’দিনে বেশ ভালোমতোই চেনা হয়ে গেছিল৷ ঘণ্টাখানেক বাদে যখন সেই শুকনো নালার কাছে এসে দাঁড়ালাম তখন সূর্য ঠিক মধ্যগগনে৷ মাথার ওপর আশ্বিনের পরিষ্কার আকাশ৷ বেশ একটা মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে৷ পাখপাখালির ডাক ছাড়া দূর দূর অবধি আর কোনো প্রাণের চিহ্নমাত্র নেই৷
বলতে দ্বিধা নেই, শুকনো নালাটার সামনে বুনো ঘাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে গা-টা একটু শিরশির করে উঠল৷ তার একটা কারণ যদি হয় মংকুর কালকের কথাগুলো, আরেকটা হচ্ছে যতই এগোচ্ছিলাম নালাটার দিকে, মনে হচ্ছিল জঙ্গল জুড়ে যেন একটা চাপা নৈঃশব্দ্য নেমে আসছে৷ মানে ধীরে ধীরে আমার আর জঙ্গলটার মধ্যে একটা পর্দা গজিয়ে উঠছে, সেটা পেরিয়ে ওদিককার আওয়াজ আর আমার কানে পৌঁছোচ্ছেই না৷