‘‘কেন কাকু? কী হয়েছে?’’
অল্প কথায় কাকু যা বললেন তা এইরকম—
মাধুরীর বিয়ে হয়েছিল প্রায় মাস সাত-আটেক আগে৷ লেখাপড়ায় মাধুরীর কোনোদিনই তেমন উৎসাহ ছিল না৷ গ্র্যাজুয়েশনের পর সে নিজেই আর পড়তে চায়নি৷ কাকুরা জোরজবরদস্তি করেননি, পালটি ঘরের সৎপাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে দেন৷
পাত্রের খোঁজ মাধুরীই দিয়েছিল৷ অনির্বাণের সঙ্গে ওর আলাপ কোনো এক বান্ধবীর বাড়িতে৷ তিনসুকিয়া থেকে আরেকটু উত্তরে গেলে সদিয়া বলে একটি জেলা আছে, সেখানেই ওদের তিনপুরুষের বাস৷ বাঙালি হলেও ওরা বহুদিন আসাম প্রবাসী৷ ছেলের চেহারাতেও একটু উত্তর-পূর্বের ছাপ আছে৷ তার অবশ্য অন্য একটা কারণ আছে৷ অনির্বাণের মা এখানকারই মহিলা৷
অনির্বাণ ছেলে হিসেবে দেখতে শুনতে ভালো৷ চাকরি করে ডিব্রুগড়ে, কোনো এক চা-বাগানের অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে৷ মাইনে খারাপ না৷ মা-বাবা মারা গেছেন অনেক আগেই৷ থাকার মধ্যে এক বিধবা দিদি, অনির্বাণের থেকে বছর পাঁচেকের বড়৷ তিনি ওর সঙ্গেই থাকেন৷ এ ছাড়া কাছের লোক বলতে এক মামা৷ এক কথায় নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার৷
কাকু ডিব্রুগড়ে লোক পাঠিয়ে গোপনে তত্ত্বতালাশ নিলেন৷ জানা গেল ছেলের স্বভাব-চরিত্র চমৎকার, নেশাভাং করে না, মেয়েঘটিত কোনো কেচ্ছাও নেই৷ ছেলের দাবিদাওয়াও বিশেষ কিছু নেই, শাঁখা-সিঁদুরেই খুশি৷
কাকুরা শেষমেশ রাজি হয়ে গেলেন৷
বিয়েটা হয়েছিল গত বছর ফাল্গুনে৷ কাকুরা যথাসাধ্য ভালোভাবে বিয়ের আয়োজন করলেন৷ কলকাতা থেকে অনির্বাণের কিছু দূরসম্পর্কের আত্মীয়স্বজনরা এলেন৷ ওর কলেজের বেশ কিছু বন্ধুবান্ধবও এল৷ বেশ হইহই হল কয়েকদিন৷
বিয়ের পরপরই ওরা চলে গেল ভুটানে, হানিমুন করতে৷ ফিরে এল হপ্তাখানেক বাদে৷ তারিখটা এখনও মনে আছে কাকুর, বিশে ফেব্রুয়ারি৷ শিবরাত্রির ঠিক দু’দিন আগে৷
ফিরে আসার পরদিনই মাধুরী বাপের বাড়ি চলে আসে৷ কথা ছিল শিবরাত্রির পরের দিন মাধুরী সদিয়া চলে যাবে৷ তারপর কয়েকদিন ওখানে কাটিয়ে ডিব্রুগড়, অনির্বাণের কর্মস্থলে৷
এই ক’দিন অনির্বাণের দিদি বাড়ি ছিলেন না, মৃত স্বামীর কিছু পেনশন সংক্রান্ত কাজে গুয়াহাটি গেছিলেন৷ তবে যেদিন অনির্বাণরা ফিরে আসে, তার আগের দিনই কাজকর্ম মিটিয়ে সদিয়া চলে আসেন তিনি৷ কামাখ্যা থেকে আনা একটি পবিত্র সিঁদুরের কৌটো উপহার দেন মাধুরীকে৷
আসল কাহিনি শুরু ঠিক শিবরাত্রির পরের দিন থেকে৷
তেইশে ফেব্রুয়ারি, মানে যেদিন মাধুরীর বেরোনোর কথা, সেইদিন দুপুর থেকে হঠাৎ করেই মাধুরীর প্রচণ্ড শরীর খারাপ৷ স্নান করে, দুপুরের খাওয়া সেরে সবে বিছানায় শুয়েছে সে৷ হঠাৎ করে ধুম জ্বর, সেই সঙ্গে ঠকঠক করে কাঁপুনি৷ দেখতে দেখতে থার্মোমিটারের পারদ পৌঁছে গেল একশো তিন ডিগ্রিতে! গা যেন পুড়ে যাচ্ছে মেয়ের, আর তার সঙ্গে সমানে চলছে প্রলাপ বকা৷
অবস্থা আরও খারাপ হল সন্ধের দিকে৷ সারা শরীর অবশ হয়ে এল মাধুরীর৷ বিছানা থেকে মাথা তোলা তো দূরস্থান, মুখ দিয়ে কোনো কথাই ফুটছে না৷ দেখে মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে সারা শরীর যেন প্যারালাইজড হয়ে যাচ্ছে৷ সারা গায়ে চাকা চাকা দাগ৷ দুটো চোখই জবাফুলের মতো লাল৷ জলপট্টি দিতে দিতে ক্রমাগত কেঁদে চলেছেন কাকিমা, আর মনে মনে ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করছেন৷ স্থানীয় ডাক্তারবাবুকে এত্তেলা দেওয়া হয়েছিল৷ তিনি এসে একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে বলে গেছেন এতে যদি অবস্থার উন্নতি না হয়, তাহলে রাত পোহালেই গুয়াহাটি নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে৷
সে রাতটা বাড়ির প্রতিটি মানুষ সাংঘাতিক উদ্বেগে ছিলেন৷ কেউ দাঁতে কুটোটি কাটেননি৷ পাড়াপ্রতিবেশীরা পালা করে খোঁজ নিয়ে যাচ্ছেন৷ প্রায় অচৈতন্য মাধুরীর মাথায় জলপট্টি দিতে দিতে কেঁদে ভাসাচ্ছেন কাকিমা৷ ওদিকে অনির্বাণের বাড়িতে ফোন করা যাচ্ছে না, লাইনে গণ্ডগোল৷ অত রাতে সদিয়াতে কাউকে পাঠানোও সম্ভব নয়৷ একে রাস্তাঘাট ভালো না, তার ওপর সন্ত্রাসবাদীদের উৎপাত তো আছেই৷ মোটমাট সব মিলিয়ে সে এক ক্যাডাভ্যারাস অবস্থা৷
কিন্তু পরের দিন আরেক চমক!
পরের দিন ভোরবেলা অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে বাড়ি ফিরে কলিং বেলের সুইচ টিপেছেন সদানন্দকাকু, দরজা খুলে দিল মাধুরী স্বয়ং! কাকু তো একেবারে হতভম্ব! কাকিমা জলপট্টি দিতে দিতে শেষরাতে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলেন৷ তিনিও দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে উঠে এসে এই দৃশ্য দেখে অবাক! মাধুরীর যাবতীয় রোগবালাই ম্যাজিকের মতোই একেবারে ভ্যানিশ! একদম ঝরঝরে তকতকে মেয়ে৷ হাসিমুখে বলল, ‘‘যাদবকাকুকে গাড়ি বার করে রাখতে বলো বাবা৷ দুপুরের খাওয়াটা সেরেই ও বাড়ি চলে যাই৷’’
কাকিমা ঠাকুর ঠাকুর করে মাথায় হাত ঠেকালেন৷ এতদিন ধরে বাড়িতে গোবিন্দের নিত্যসেবা করছেন সে কি এমনি এমনি? ভক্তির একটা জোর নেই?
তারপর ঠিক এক সপ্তাহ৷ ঠিক এক সপ্তাহ বাদে মেয়ে তার যাবতীয় জিনিসপত্র দু-দুটো ঢাউস স্যুটকেসে বোঝাই করে ফিরে এল এ বাড়িতে৷ বাড়ির দরজায় সে দুটো নামিয়ে দিয়ে থমথমে মুখে সদানন্দকাকুকে বলল, ‘‘আমি ফিরে এলাম বাবা৷ আমাকে রাখতে হয় রাখো, ফেলতে হয় ফেলো, কিন্তু আমি কিছুতেই আর ও বাড়ি ফিরে যাব না৷’’