পরের দিন থেকেই আমার কাজ শুরু হয়ে গেল৷ রোজ সাতসকালে উঠে খেয়েদেয়ে কাঁধে ক্যামেরাটা ঝুলিয়ে জঙ্গলে বেরিয়ে যাই, ফিরি দুপুর নাগাদ৷ দুপুরে খেয়েদেয়ে ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম করে ফের জঙ্গল অনুসন্ধান৷ ফিরে আসতে হয় সন্ধ্যা হওয়ার আগেই৷
তারপর সদানন্দকাকুদের সঙ্গে চা-তেলেভাজা সহযোগে বিপুল আড্ডা৷ রাতের এলাহি ডিনারের কথা তো ছেড়েই দিলাম৷
এই করে করে যখন দিন পাঁচ-ছয় কেটেছে, তখনই ঘটল ঘটনাটা৷
এই ক’দিনে আমি প্রায় তন্নতন্ন করে খুঁজেছি সারা জঙ্গলটা৷ মাগুরি বিল বেশ বড় বিল, চারিপাশে ঘন জঙ্গল৷ তার আশপাশে প্রায় তন্নতন্ন করে খুঁজেও কিছুই পাইনি৷ শুধু বাদ রয়ে গেছিল দক্ষিণ-পূর্ব দিকটা৷
টাউন থেকে জঙ্গলে ঢোকার যে প্রধান রাস্তাটা, সেটা পশ্চিম দিকে৷ সেখান থেকে বিলের দক্ষিণ-পূর্বে যাওয়ার কোনো চলাচলের রাস্তা তো নেই-ই, তার ওপর মাঝে একটা বড় শুকনো নালা আছে৷ প্রথম থেকেই লক্ষ করেছিলাম যে ওদিকে যেতে মংকুর তীব্র অনীহা৷ ওদিকে যাওয়ার নাম শুনলেই ছোকরার চোখে-মুখে চকিতের জন্য একটা অস্বাভাবিক ছায়া খেলে যায়৷
ওই রাস্তাটার কথা ভুলেই গেছিলাম৷ সাতদিনের শেষে নিষ্ফলা অভিযানের শেষে ফিরে আসছি, মনটা ব্যর্থতার বিষাদে তিক্ত হয়ে আছে, এমন সময় হঠাৎ করে আমার সেই শুকনো নালাটার কথা মনে পড়ে গেল৷ আরে যাহ, ওদিকে যাওয়া হল না তো!
কথাটা মংকুকে বলতেই দেখি সে ছোঁড়া অবাধ্য ঘোড়ার মতো ঘাড় বাঁকিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গেল, ‘‘মাফ করো দাদা, ওইদিকে যাব না৷’’
‘‘সে কী? কেন?’’ আশ্চর্য হলাম, ‘‘এই যে সেদিন বললি মালিকের খাস আদমির পছন্দমতো সব ছবি তুলিয়ে দিবি আমায়?’’
ঘাড় ত্যাড়া করে খানিকক্ষণ মাটির দিকে তাকিয়ে রইল ছোকরা, তারপর ভয়ার্ত স্বরে ইতিউতি তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, ‘‘ওদিকে যেতে পারব না গো দাদা, ওদিকে যাওয়া আমাদের বারণ আছে৷’’
‘‘আমাদের মানে কাদের?’’
‘‘আমাদের সব্বার৷ দিবংগোঁয়্যা, বড়গোঁয়্যা, তেঙাপোনিয়া, সব্বার মানা ওদিকে যাওয়ার৷’’
এরা কারা সেসব বুঝলাম না৷ ‘‘কে মানা করেছে রে?’’ পালটা প্রশ্ন করলাম আমি৷
‘‘বড়দেওরি’’, মংকুর ফিসফিস করে বলা কথাগুলো সন্ধের অন্ধকারে বড় অদ্ভুত শোনাল৷
আমি একবার তাকালাম সেই জঙ্গলের দিকে৷ আশ্বিনের আকাশ থেকে সন্ধে নেমে আসছে দ্রুত৷ সারা আকাশ জুড়ে ঘরফেরত পাখিদের ডানা ঝাপটানো আর কলরবের আওয়াজে কান পাতা দায়৷ ছোটবেলা থেকেই আমার বিশেষ কিছু সেন্স বড় প্রবল, কোথাও কোনো অশরীরী বা অলৌকিক কিছু ঘটলে আগে থেকেই কিছু একটা আঁচ করতে পারতাম৷ সেই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে হঠাৎই মনে হল, ওদিকে যেন কিছু একটা আছে৷ সেটা কী বুঝতে পারছি না, তবে স্পষ্ট অনুভব করতে পারছি৷ যেন একটা একটা দুর্ষ্ণেয় শক্তি আমাকে চুম্বকের মতো ওদিকে টানছে৷ তার কোনো শুভাশুভ নেই, পাপ-পুণ্য নেই, উল্লাস বা হাহাকার নেই, শুধু এক উদাস রিক্ততা আছে, তাকে ভাষায় বর্ণনা করা খুব কঠিন৷
আচ্ছন্ন স্বরে প্রশ্ন করলাম, ‘‘ওদিকে কী আছে মংকু?’’
গলাটা একদম নামিয়ে ফিসফিস করে বলল মংকু, ‘‘কাউরীবুড়ির মন্দির৷’’
* * * *
সেদিন রাত্তিরের খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে নিজের ঘরে এসেছি, এমন সময় দরজায় ঠকঠক৷ দরজা খুলতেই দেখি সদানন্দকাকু দাঁড়িয়ে, সঙ্গে কাকিমা৷
তাড়াতাড়ি দুজনকে ঘরে এনে বসালাম৷ কাকু প্রশ্ন করলেন, ‘‘কী ব্যাপার ভব, আজ তোমাকে কেমন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে? তোমার শরীর ভালো তো?’’
আমি বললাম, ‘‘না না কাকু, আমার শরীর একদম ঠিক আছে৷ ও নিয়ে উদ্বিগ্ন হবেন না৷ আসলে যাওয়ার সময় চলে আসছে তো, তাই মনটা খারাপ হয়ে আছে৷’’
কাকিমা শশব্যস্ত হয়ে উঠলেন, ‘‘ও মা, এ কী কথা? এই তো সেদিন এলে, এখনই এত যাই যাই কীসের? ভালো করে তো খাতিরযত্ন করাই হল না৷’’
হাত জোড় করে বললাম, ‘‘কাকিমা, এই ক’দিনে যা খাতিরযত্ন করেছেন, তাতে এই ক’দিনে নির্ঘাত আমার ওজন কম সে কম দশ কিলো বেড়ে গেছে৷ মা মারা গেছেন ছোটবেলাতেই, তারপর থেকে আজ অবধি এত আদরযত্ন কারও কাছ থেকেই পাইনি৷’’
কাকিমার চোখটা ছলছল করে এল, একটু ঝুঁকে এসে আমার মাথায় একবার হাত বুলিয়ে দিলেন৷
কাকু গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘‘তাহলে আর যাই যাই করছ কেন? অন্তত মাসখানেক থেকে যাও৷’’
হেসে ফেললাম, ‘‘কাকু, আপনি তো নিজেও সরকারি অফিসার৷ জানেনই তো ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে এখন লোকের কীরকম অভাব৷ বড়সাহেব তো ছুটি দিতেই চাইছিলেন না৷ বহুকষ্টে তাঁকে রাজি করিয়ে তবেই এখানে আসতে পেরেছি৷ এখন যদি আর ছুটি বাড়াই, তাহলে আমার ওপরওয়ালা বোধহয় রামদা হাতে আমার খোঁজে এখানেই হানা দেবেন৷’’
‘‘হুম’’, এই বলে খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন দুজনে, তারপর কাকু একটু ইতস্ততভাবে বললেন, ‘‘আচ্ছা বাবা, তুমি তো আয়ুর্বেদচর্চা করো বললে৷ তোমাদের শাস্ত্রে ডিপ্রেশন বা মনখারাপ সারাবার ওষুধ নেই?’’
ডিপ্রেশন মানে ঠিক মনখারাপ নয়, ওটা একটা মেডিক্যাল কন্ডিশন৷ তবে সে ভুলটা আর কাকুকে ধরিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম না৷ প্রশ্ন করলাম, ‘‘কিছু কিছু আছে কাকু, কিন্তু কেন? আপনার আবার ডিপ্রেশনের ওষুধের দরকার পড়ল কেন?’’
‘‘আমার না বাবা, মাধুরীর৷’’