দুটো হাত হাঁটুতে ভর দিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম একবার৷ ঠিক তখনই শব্দটা কানে এল৷ মৃদু৷ সন্তর্পণ৷ কাছে৷ খুব কাছে৷
আস্তে আস্তে ঘাড়টা বাঁদিকে ঘোরালাম৷ ও দাঁড়িয়ে আছে৷ আমার থেকে খানিকটা দূরে৷
কে ও? কী নাম ওর?
নাহ, এখন আর ওর কোনো নাম নেই৷
দৈর্ঘ্যে আমার থেকে এক হাত উঁচু৷ কুচকুচে কালো গায়ের রং৷ অন্ধকারের মধ্যেও বুঝতে পারছিলাম সারা শরীরে ঢেউ খেলছে পেশি৷ কাঁধের পাশে দুটো ডানার আভাস, যদিও সে দুটো মিলিয়ে আসছিল দ্রুত৷ নাক আর মুখ মিলিয়ে যেটা আছে সেটা চঞ্চু বা ঠোঁট ছাড়া আর কিছু হতে পারে না৷ আর চোখ, উফ, সেই ভয়ানক চোখ৷ স্থির অচঞ্চল চোখে সেই দানব তাকিয়ে ছিল আমার দিকে৷
কী ছিল সেই দৃষ্টিতে? রাগ? ক্ষোভ? প্রতিশোধের বাসনা?
ডানদিকে ঘুরেই দৌড় দিলাম আমি৷ আমাকে পৌঁছোতে হবে ওই বিলে৷ যে করে হোক, যে-কোনো মূল্যে হোক৷
ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়োচ্ছিলাম আমি৷ পেছন থেকে ভেসে আসছিল কাঠপাতা ভাঙার মড়মড় শব্দ৷ এত কাছে এসে শিকারকে হাতছাড়া হতে দেবে না সে৷ প্রতি মুহূর্তে তার সঙ্গে আমার ব্যবধান কমে আসছিল৷ প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল এই বুঝি আমার ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সাক্ষাৎ মৃত্যু! ও আসছে, ও আসছে…
দুটো শরীর একসঙ্গেই ঝাঁপ দিল বিলের জলে৷
প্রথমে বেশ খানিকটা তলিয়ে যাওয়ার পর জলের নীচে স্থির হলাম৷ এই অন্ধকারে কয়েক হাত জলের নীচে কিছুই দেখার সম্ভাবনা নেই৷ স্থির হয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলাম কোথায় গেল ও!
হঠাৎ কে যেন বড় বড় নখ দিয়ে খামচে ধরল আমার পা দুটো, আর টেনে নিয়ে যেতে চাইল জলের নীচে৷ দ্রুত, খুব দ্রুত জলের মধ্যে ডুবে যেতে থাকলাম আমি৷ ছটফট করতে থাকলাম উঠে আসার জন্য, প্রাণপণে চেষ্টা করতে থাকলাম…
কিন্তু না! সব চেষ্টা ক্রমে ব্যর্থ হতে থাকল৷ আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে৷ প্রবল বেগে ছটফট করছি, একটু একটু করে আমার চোখের সামনেটা অন্ধকার হয়ে আসছে৷ আর বোধহয় শেষরক্ষা হল না৷ চোখের সামনে গাঢ় অন্ধকারের পর্দা নেমে এসেছে, শিথিল হয়ে এসেছে শরীরের পেশিগুলো, আমি হাল ছেড়ে দিয়েছি, এমন সময় আমার মনে হল ডুবে যেতে যেতে হঠাৎ করে থমকে দাঁড়ালাম৷
বহু কষ্টে মাথাটা একটু তুললাম৷ দেখলাম যে মাথার ওপরের জলটা যেন আলো হয়ে আছে৷ আর সেখান থেকে দুটো হাত নেমে এল জলের মধ্যে৷ পুরুষ নয়, নারীর হাত৷ দুটি নিরাভরণ কৃশকায় হাত আমার কাঁধদুটো আঁকড়ে ধরল সজোরে, আর টেনে নিয়ে যেতে লাগল জলের ওপরে৷
শুরু হল প্রাণপণ লড়াই৷ ধারালো নখের আঁচড় কেটে বসছে আমার পায়ের মাংসে৷ ওপরের টানও ক্রমশ বেড়ে উঠেছে৷ একসময় বুঝতে পারলাম নীচের দিকের টান আলগা হয়ে আসছে ক্রমশ৷ যত ওপরে উঠছি, তত আমার হাতে সাড় ফিরে আসছে৷ বেঁচে যেতে পারি, এই বোধটুকু আমার মাথার মধ্যে গেঁথে যেতেই আমার শরীরে আর মনে দুনো বল এল৷ আমি সাঁতার কেটে উঠছি, উঠছি…আরও ওপরে উঠছি…জলের ওপর আলোটা এখন অনেক স্পষ্ট৷ শরীর আর মনের সবটুকু জোর একত্র করে সেদিকে সাঁতার কাটতে লাগলাম আমি৷ মনে হচ্ছে ওই জলের মধ্যেই আমার শরীর ঘিরে যেন আলোর বন্যা বইছে—সেই আলোয় জলের অতলে বহুদূর অবধি দেখা যাচ্ছে৷ প্রাণপণে ওপরে উঠতে উঠতেই নীচের দিকে তাকিয়ে একটা অপার্থিব অলৌকিক দৃশ্য দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম৷
দেখি যে মহামৃত্যুবিহঙ্গ আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল অতল জলের গভীরে, তার সারা শরীর গ্রাস করেছে একঝাঁক জলজ লতা৷ সেই দ্রুত বেড়ে ওঠা লতার ঝাঁক হাত-পা বেঁধে ফেলছিল তার, আর প্রধান লতাটি কালসর্পের মতো নির্ভুল লক্ষ্যে পেঁচিয়ে ধরছিল ওর গলা৷
ছটফট করতে করতে তলিয়ে যাচ্ছিল ও, আড়াইশো বছর ধরে বেঁচে থাকা এক প্রেত৷ তার শ্বাস বন্ধ করে দিচ্ছিল আমার খুব পরিচিত একটি গুল্ম৷ আর আর সেই গুল্মের মাথাটা ছোবল দিতে ওঠা সাপের ফণার মতো!
এতদিনে বুঝলাম ওসমানের এনে দেওয়া পুথিটার সেই অদ্ভুত শ্লোকের অর্থ, গোলকপুষ্পাৎ মহাভয়ং সঞ্জাতং যদ্ভবিষ্যতে৷ তদ্ভয়ং নিবারণার্থং গোলকপুষ্পং বিধীয়তে৷ গোলকপুষ্প থেকে যদি মহাভয় উৎপন্ন হয়, তাহলে গোলকপুষ্পই তোমাকে রক্ষা করবে!
কোনোমতে হাঁপাতে হাঁপাতে ডাঙায় উঠে কাদার মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম৷ শরীরে আর একবিন্দু শক্তি অবশিষ্ট ছিল না৷
খানিকক্ষণ পর মাথা তুলে দেখি পুবের আকাশ খানিকটা লাল৷ তবুও অন্ধকার কাটেনি পুরোটা৷ চোখের পাতায় জলকাদা লেগে সামনেটা ঝাপসা দেখাচ্ছিল৷ সেই আলো-অন্ধকারের মধ্যে দেখলাম আমার থেকে কিছু দূরে এক বৃদ্ধা রমণী ধীরে ধীরে হেঁটে মিলিয়ে যাচ্ছেন জঙ্গলের মধ্যে৷ সামান্য ন্যুব্জ হয়ে হাঁটছেন তিনি৷ পরনে বিধবার বেশ৷ বাতাসে উড়ছে তাঁর শ্বেতশুভ্র কেশরাজি৷ চলে যেতে যেতে একবার থামলেন তিনি, তারপর ঘাড় ঘোরালেন আমার দিকে৷
আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম৷’’
* * * *
চাটুজ্জেমশাইয়ের গল্প শেষ৷ সবাই স্তব্ধ হয়ে বসে আছে৷ রাত হয়েছে অনেক৷ বাইরের বৃষ্টিটাও ধরেছে খানিকটা৷
প্রথম প্রশ্ন করল গদাই, ‘‘আপনার কাকার আর কোনো খবর পাননি পরে?’’
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন চাটুজ্জেমশাই, ‘‘না হে৷ কোনো খবর নেই৷ শিলিগুড়িতে যে পাড়ায় থাকেন বলে জানিয়েছিলেন, সেখানে গেছিলাম খোঁজ করব বলে৷ পাড়ার লোক তো শুনে আকাশ থেকে পড়ল৷ বলে ওই নামের বা ওই চেহারার লোক কস্মিনকালেও ও পাড়ায় দেখেনি কেউ৷’’