কিন্তু আজ তাদের চোখে জিঘাংসার বদলে অন্য কিছু ছিল৷ ভয়৷ মহাভয়৷ মৃত্যুভয়৷
হঠাৎ করে থেমে গেল কাকার অদ্ভুত মন্ত্রোচ্চারণ, তারপর উত্তেজিতভাবে নির্দেশ করলেন মন্দিরের ভেতরের দিকে৷
এতক্ষণে মন্দিরের ভেতরে চোখ গেল আমার, আর হৃৎপিণ্ডটা প্রায় কণ্ঠার কাছে এসে আটকে গেল৷
গোলকপুষ্পের লতা তখন প্রায় ঢেকে ফেলেছে অনির্বাণের শরীর৷ মনে হচ্ছিল যেন একটা সবুজ মমি পড়ে আছে মন্দিরের মেঝেতে৷ তখনও তার ওপর দিয়ে সাপের মতো বেড়ে চলেছিল সেই শয়তানের লতা৷ তার ওপর ঝুঁকে পড়েছেন অনির্বাণের দিদি, জান্তব স্বরে আর্তনাদ করতে করতে পাগলের মতো ঝাঁকাচ্ছেন অনির্বাণের দেহ৷ দু’হাতে ছিঁড়ে ফেলতে চাইছেন সেই দৃঢ়বদ্ধ লতাজাল৷ কিন্তু হায়, ব্যর্থ সাধনার অভিশাপ তখন আর ফেরাবার উপায় নেই৷
মন্দিরের ভেতরের দিকে ক্ষেপণাস্ত্রের মতো ধেয়ে গেল একদলা অগ্নিপিণ্ড৷
ঠিক তখনই মাথার ওপর শোনা গেল শনশন শব্দ৷ মাথা উঁচু করে দেখলাম বিশাল কিছু একটার ছায়া আকাশের বুক ছেয়ে নেমে আসছে আমাদের দিকে৷
‘‘পালাও ভবতারণ, পালাও৷ ও আসছে তোমারই জন্যে৷ যেভাবে হোক পালাও এখান থেকে, নিজের প্রাণ বাঁচাও৷’’
প্রবল ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘ওটা কী কাকা? কী নেমে আসছে আকাশ থেকে?’’
‘‘কী নয়, বলো কে৷’’
আমার মুখ থেকে কথা বেরোল না৷ তার আগেই বলে উঠলেন কাকা, ‘‘পালাও ভবতারণ, এখনই পালাও, যেদিকে দু’চোখ যায়৷ আজ ও তোমাকে আর আমাকে এখানে টেনে এনেছে খুন করবে বলেই, সেটাই ওর আসল উদ্দেশ্য৷ ও এই ডাইনির দোসর, সমস্ত পাপের ভাগীদার৷ সেইজন্যই ও অত সহজে অনির্বাণকে আমাদের জন্য নিয়ে আসতে পেরেছিল৷ সেইজন্যই ও যখন আজ এখানে ঢোকে, কাউরীবুড়ির অনুচরেরা ওর ক্ষতি করেনি৷ ওই-ই আজ কাকভোগ তুলে দিয়েছিল ওই রাক্ষসীর হাতে…’’
‘‘কিন্তু কাকা…আপনি কী করে এত নিশ্চিত হচ্ছেন?’’
এই প্রথম উত্তেজিত হতে দেখলাম কাকাকে, তিনি চিৎকার করে বললেন, ‘‘মনে করে দ্যাখো ভবতারণ, মন্দিরে ঢুকে যখন আমি যখন বললাম, ‘টর্চ জ্বালো ভবতারণ, মায়ের মুখখানি দেখতে দাও’, তখন কিন্তু তোমার সঙ্গে সঙ্গে ওর টর্চের আলোও আছড়ে পড়েছিল মাতৃমূর্তির ওপরে৷ ও কী করে জানল দেবীমূর্তি মন্দিরের ঠিক কোথায়, যদি না ও এখানে আগে থেকেই এসে থাকে? যেদিন ও মংকুর মুখে শুনেছে তোমার এখানে আসার কথা, সেদিন থেকে ও তোমার পেছনে ঘুরছে মৃত্যু হয়ে, কাউরীবুড়ির ছায়া হয়ে৷ তোমাকে ও কাউরীবুড়ির কাছে বলি দিতে চায় ভবতারণ, পালাও৷ আমার কথা ভেবো না, এক্ষুনি পালাও এখান থেকে৷ যেদিকে দু’চোখ যায়…’’
ততক্ষণে মানুষপ্রমাণ বিহঙ্গমটির ছায়া সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত হয়ে নেমে আসছে আমার মাথার ওপর৷ তার হিংস্র নখের সারি বেরিয়ে এসেছে উদগ্র আয়ুধের মতো৷ তার দিকে তাকিয়ে মোহগ্রস্তের মতো বললাম, ‘‘এ কি…এ কি…তাহলে…’’
‘‘হ্যাঁ ভবতারণ, মগলহানজামা মারা যায়নি৷ চাংদেওমাই তাঁর প্রাণের চেয়েও প্রিয় সঙ্গীকে এই অদ্ভুত ক্ষমতা দিয়ে যান৷ আড়াইশো বছর ধরে মগলহানজামার মৃত্যুহীন আত্মা রক্ষা করে এসেছে তাঁর উত্তরাধিকারীদের, আদেশ পালন করে এসেছে পাতরগোঁয়্যাদের বড়দেওরিদের৷ এই-ই হত্যা করেছে অনির্বাণের বাবাকে, এই-ই ধর্মনাশ করতে উদ্যত হয়েছিল মাধুরীর৷ মগলহানজামা-ই আসলে পরাগ বসুমাতারি…’’
আমি আর শুনিনি৷ দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড় দিলাম জঙ্গলের মধ্য দিয়ে৷ শুধু তার আগে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, যেখানে দাঁড়িয়ে কাকা কথা বলছিলেন, সে জায়গাটা ফাঁকা! সেখানে কেউ নেই!
* * * *
আমি প্রাণভয়ে দৌড়োতে থাকলাম জঙ্গলের আরও ভেতরে৷ গাছের ডাল সপাং সপাং করে আছড়ে পড়ছে আমার চোখেমুখে, পা আটকে যাচ্ছে লতায়, ঘাসে৷ কোনোমতে সেগুলো ছাড়িয়ে জঙ্গলের আরও গভীরে ঢুকে যেতে চাইছি আমি৷ আমি জানি, এখন এই জঙ্গলই আমার রক্ষাকর্তা৷ মাঝে মাঝে ওপরে তাকিয়ে দেখছি, গাছের মাথার ফাঁকে দেখা যাচ্ছে সেই বিশাল কালো ছায়া৷ মৃত্যুর ছায়া উড়ে আসছে আমার পালাবার পথ অনুসরণ করে৷ বিন্দুমাত্র ফাঁকা জায়গা পেলেই আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে সে৷
ছুটতে ছুটতে একটা বড় গাছের আড়ালে দাঁড়ালাম কিছুক্ষণ৷ বুকটা হাপরের মতো ওঠানামা করছিল৷ চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস নিলাম৷ সারা গা বেয়ে দরদর করে নামছে ঘামের স্রোত৷ হাত-পা কাঁপছে থরথর করে, ভয়ে, আতঙ্কে৷
চোখটা খুলে চারিদিক দেখে নিলাম একবার৷ আর তখনই একটা ব্যাপার লক্ষ করলাম৷
ঝিঁঝিপোকার ডাক৷ আমি ঝিঁঝিপোকার ডাক শুনতে পাচ্ছি৷ শুনতে পাচ্ছি রাতচরা পাখিদের ক্ষীণ আওয়াজ৷
তাহলে কি আমি নিজের অজান্তেই পেরিয়ে এসেছি ওই অভিশপ্ত মন্দিরের চৌহদ্দি?
মাথার ওপরে তাকালাম, গাছের ফাঁক দিয়ে যতটা দৃষ্টি যায়৷ পুবের আকাশ খুব অল্প লাল৷
ডানদিকে তাকিয়ে দেখি জঙ্গল পাতলা হয়ে এসেছে অনেকটাই৷ ডালপালার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে জঙ্গলের গা ঘেঁষে এক বিশাল জলাশয়৷ মাগুরির বিল৷
কী করব আমি? জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে থাকব দিনের আলো ফোটা অবধি? ওর হাত থেকে বাঁচার জন্য এ ছাড়া আর উপায় আছে?
ফের একবার আকাশের দিকে তাকালাম৷ কোথায় ও?
মাথার ওপরে কেউ নেই৷ কিচ্ছু নেই৷