দু’হাত তুলে উন্মাদের মতো হেসে উঠলেন সেই নারী৷ জয়, জয় হয়েছে তাঁর৷ তাঁর আহ্বান শুনে ঘোর পাতাল থেকে উঠে আসছে সেই শয়তানি লতা৷ আজ তিনি সিদ্ধকাম৷ আজ তিনি জয়ী৷
অনির্বাণের পিঠ থেকে উঠে দ্রুতপায়ে মন্দিরের বাইরে এসে দাঁড়ালেন সেই উলঙ্গিনী যক্ষিণী৷ তারপর মন্দিরের সামনের চত্বরটি বৃত্তাকারে ঘুরতে শুরু করলেন তিনি, দু’হাত উপরে তুলে উচ্চৈঃস্বরে আউড়ে যেতে লাগলেন কোনো এক সুরেলা মন্ত্রগান৷ মানুষের স্মৃতির অনধিগম্য কোন এক অশরীরী গানের সুর ঘুরে বেড়াচ্ছিল সেই আদিম বনভূমি জুড়ে৷ তার ক্ষয় নেই, তার লয় নেই, তার আদি নেই, তার অন্ত নেই৷ সেই ভৌতিক অপেরা-সংগীত কান্নার সুরে মাতাল করে তুলছিল অন্ধকার রাত, আর সেই নিঃসাড় বনাঞ্চল৷
কাকা আমার হাত চেপে ধরলেন, ‘‘গাছের দিকে তাকাও ভবতারণ৷’’
দেখি মন্দিরের পিছনে গাছের ডালে উড়ে এসে বসেছে কাকেদের দল৷ তাদের দৃষ্টি এখন পাতরগোঁয়্যাদের বড়দেওরির দিকে, যিনি বাতাসে মিশিয়ে দিচ্ছিলেন দুর্বোধ্য ভাষার আহ্বান৷ সেই আহ্বান ক্রমেই আরও উচ্চকিত হয়ে উঠছিল৷ হয়ে উঠছিল আরও তীব্র, আরও তীক্ষ্ণ৷
হঠাৎ করে দেখি তারা নেই, অকস্মাৎ উধাও হয়ে গেছে কোথাও! কাকার দিকে মুখ ফিরিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তিনি আঙুলটা ঠোঁটের ওপর চেপে ধরলেন৷ ইশারা করলেন সামনের দিকে দেখতে৷
যেমন হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে গেছিল কাকেদের দল, ঠিক তেমনই হঠাৎ করে মন্দিরের পেছনের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল একদল নারী৷ তাদের আহ্বানকারীর মতো তারাও নগ্ন, উলঙ্গ৷ সেই ঘোর কৃষ্ণবর্ণা রমণীর দল ঘিরে দাঁড়াল তাদের কর্ত্রীকে৷ তারপর মাটিতে বসে তারাও দু’হাত উপরে তুলে গাইতে লাগল সেই অলৌকিক প্রার্থনাসংগীত৷
এই দৃশ্য দেখে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এসেছিল৷ কোনোমতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘এরা কারা কাকা?’’
‘‘এরা তারাই ভবতারণ, যারা দেবীর আদেশে এক রাত্রের মধ্যে ধ্বংস করেছিল পাতরগোঁয়্যাদের৷ এরা তারাই, যাদের তুমি প্রথম দিন দেখেছিলে এখানে আসার সময়৷ ওরা কাউরীবুড়ির অনুচর ভবতারণ, পাতাল থেকে উঠে আসা অন্ধকারের প্রহরী৷ আড়াইশো বছর ধরে ওরা পাহারা দিয়ে এসেছে তাদের আরাধ্যা দেবীর মন্দির৷ অপেক্ষা করে আছে কবে কোনো এক বড়দেওরি এসে মুক্তি দেবেন ওদের৷’’
আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমেল স্রোত বয়ে গেল, ‘‘কিন্তু এরা এখন এখানে কেন কাকা? কেন ডেকে আনা হয়েছে ওদের?’’
‘‘ভয় পেও না ভবতারণ৷ যদি আমার কিছুমাত্র যোগবিভূতি থাকে, যদি নিষ্ঠাভরে দেবীর পূজার্চনা করে থাকি, তবে শুনে রাখো, আজ এই সাধনার ফল অতি ভয়ংকর হবে৷ যে মহান বিদ্যা হাজার বছর ধরে গুপ্ত ছিল, গুহ্য ছিল, প্রকটিত হত শুধুমাত্র সমষ্টির স্বার্থে, আজ তাকে প্রয়োগ করা হয়েছে অতি হীন উদ্দেশ্যে৷ ওই যক্ষিণী নারী কেবলমাত্র নিজের স্বার্থ পূর্ণ করার জন্য, নিজের অতৃপ্ত কামবাসনার আগুনে আহুতি দেওয়ার জন্য আয়োজন করেছে দেবী ধূমাবতীর গোপনতম চক্রসাধনার৷ এর ফল অতি ভয়াবহ ভবতারণ৷ জেনে রাখো, আজ এই উন্মুক্ত প্রান্তরে, আড়াইশো বছর পর আবার দেবীর ক্রোধ নেমে আসবে৷ আর এবার নেমে আসবে অন্য কারও ওপর নয়, নেমে আসবে পাতরগোঁয়্যাদের শেষ বড়দেওরির ওপরে৷’’
কাকার শেষের কথাগুলো আমার কানে ঢুকছিল না৷ কারণ ভ্রূকুটি-থমথম আকাশের নীচে, নির্জন বনভূমির মধ্যে এক উন্মুক্ত প্রান্তরে একদল নগ্ন ছায়ারমণীর নাচ ক্রমেই আরও উদ্দাম, আরও অপার্থিব হয়ে উঠছিল৷
চোখটা একবার বন্ধ করে আবার খুললাম৷ হা ঈশ্বর, এসব কী দেখছি আমি?
কাকার দিকে চাইতে দেখি চোখ বন্ধ করে কী যেন উচ্চারণ করছেন তিনি৷ কোনো মন্ত্র কি? হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে৷ কিন্তু…কিন্তু ভাষাটা সংস্কৃত নয়৷
এমনকি আমার চেনাজানা কোনো ভাষাই নয়!
এ সেই ভাষা, যাতে একটু আগে মন্ত্রোচ্চারণ করছিলেন ওই নাগযক্ষিণী৷
আমার সবকিছু গুলিয়ে গেল৷ ইনি কী করে জানলেন এই ভাষা? এই মন্ত্র? আসলে কে ইনি?
আমার ভাবার মধ্যেই হঠাৎ এক আর্ত চিৎকারে খানখান হয়ে গেল চারিদিক৷ তাকিয়ে দেখি সমস্ত চত্বর জুড়ে দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছে আগুন৷ মুহূর্তের মধ্যে লেলিহান হয়ে উঠেছে তার শিখা৷ তার থেকে বেরিয়ে আসার পথ নেই৷ সেই আগুনের রং লাল, টককে লাল, ঠিক যেমন আমাদের যজ্ঞের আগুনটি ছিল৷ আর ভিজে কাঠ পোড়ার একটা খুব চেনা ভ্যাপসা, শ্বাসরুদ্ধকর গন্ধ তীব্র হয়ে বেড়ে উঠে আমার চৈতন্য আচ্ছন্ন করে দিল৷
সামনে ছড়িয়ে থাকা ভূখণ্ডখানি জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছিল আর্তনাদ, আতঙ্কের লেলিহান শিখা৷ আমাদের যজ্ঞের ছাই যেখানে যেখানে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেই প্রতিটি ভস্মকণা থেকে উত্থিত হয়ে উঠেছিলেন মহাহুতাশনসর্প৷ সেই মহাপাবক লেলিহান শিখায় পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিল ওরা৷ তাদের আর্তনাদ আমাকে বধির করে দিচ্ছিল৷ আমি ছটফট করে উঠছিলাম৷ আজ এতগুলো মানুষের মৃত্যু দেখতে হবে আমাকে?
ভাবতে ভাবতেই কতগুলো ক্র্যাঁড়ও ক্র্যাঁও স্বরে আর্ত চিৎকার ভেসে এল আমার কানে৷ সে অমানুষিক আওয়াজ কীসের? কীসের আওয়াজ ওগুলো? এত পালক পোড়ার গন্ধই বা আসছে কোথা থেকে?
আস্তে আস্তে আমার চোখের সামনে মূর্ত হয়ে উঠল একদল মানুষ প্রমাণ আকারের পাখির দল৷ আগুনের মাথা ছাড়িয়ে উঁচু হয়ে উঠেছে তাদের কালো মাথা, তাদের বাঁকানো ক্ষুরধার চঞ্চু৷ আর জ্বলন্ত হলুদ চোখের মধ্যিখানে উন্মত্তের মতো ঘুরছে লাল টকটকে মণিগুলি৷ আজ বুঝতে পারলাম কোন মহাভয়ংকর নারকী পাখির দল সেদিন নেমে এসেছিল পাতরগোঁয়্যাদের গ্রামে!