মহিলা এবার কিছু ফুল ইত্যাদি তুলে নিয়ে একবার মূর্তির পায়ে ছোঁয়ালেন, তারপর ছুড়ে দিলেন অনির্বাণের বুকের দিকে৷ তারপর তুলে নিলেন আরও কিছু, দেবীর পায়ে ছুঁইয়ে রাখলেন অনির্বাণের মাথায়৷ সঙ্গে ক্রমাগত চলছিল মন্ত্রোচ্চারণ৷
এইরকম চলল বেশ কিছুক্ষণ৷ তারপর মহিলা উঠে মন্দিরের বাইরে এলেন৷ এদিক-ওদিক দেখে বাঁদিকে একটু এগিয়ে কী একটা তুলে নিলেন মাটি থেকে৷ অন্ধকারে মনে হল কী যেন একটা ছটফট করছে মহিলার হাতে৷
কাকা আমার হাতে আলতো চাপ দিলেন, ‘‘তৈরি হও ভবতারণ৷ যা আশঙ্কা করেছিলাম তাই ঘটতে চলেছে৷’’
‘‘কী আশঙ্কা কাকা?’’
‘‘একটু আগেও দেখেছিলে ওখানে কিছু রাখা আছে বলে?’’
‘‘কই, না তো!’’
‘‘তাহলে ওটা ওখানে এল কী করে?’’
জবাব দেওয়ার আগে আমার চোখ চলে গেল মন্দিরের ভেতরে৷ হাতের ভেতরে ছটফট করতে থাকা প্রাণীটাকে দেবীর পায়ের কাছে রাখা হাড়িকাঠে চড়িয়েছেন মহিলা৷ আর তারপর আগের দিনের মতোই একটা ধারালো ছুরি দিয়ে উচ্চৈঃস্বরে কী একটা মন্ত্র পড়তে পড়তে তার মাথাটা কেটে ফেললেন৷
আগের দিনই দেখেছি এই জিনিস ঘটতে, আমার আঁতকে ওঠার কথা নয়, তবুও উঠলাম৷ কারণ এইবার যে প্রাণীটাকে উনি বলি দিলেন সেটা একটা কাক!
কাকা অস্পষ্ট স্বরে বললেন, ‘‘কাকভোগ!’’
বলির রক্তটা গড়িয়ে যাচ্ছিল গোলকপুষ্পের দিকে৷ মহিলা সেই রক্ত তুলে নিয়ে তিলকের মতো টেনে দিলেন অনির্বাণের কপালে৷ তারপর অনির্বাণের গায়ের উড়নিটা একটানে খুলে ফেললেন৷
কাকা অস্ফুটে বললেন, ‘‘যক্ষিণীচক্র শুরু হতে চলেছে ভবতারণ, চূড়ান্ত সময় আগতপ্রায়৷ সতর্ক হও, চোখকান খোলা রাখো৷ যাই ঘটুক না কেন, আমি যখন যেটা করতে বলব তখন সেটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে৷ আমার আদেশের যেন অন্যথা না হয়৷’’
ততক্ষণে অনির্বাণকে উপুড় করে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে দেবীমূর্তির পায়ের কাছে৷ তার দুই হাত সামনে, হাড়িকাঠটিকে বেষ্টন করে প্রসারিত৷ এখান থেকেই বুঝতে পারছি সম্পূর্ণ নগ্ন সে৷ মহিলা ঝুঁকে পড়েছেন ওর ওপর, পিঠে কী যেন একটা এঁকে দিচ্ছেন রক্ত দিয়ে৷ দুই কাঁধের ওপর রাখলেন কিছু রক্তবর্ণ পুষ্পগুচ্ছ৷
তারপর মহিলা উঠে দাঁড়ালেন৷ খুলে ফেললেন নিজের পরনের কাপড়৷ আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল৷ যক্ষিণীচক্রের শুরু৷
মহিলা অনির্বাণের পিঠের ওপর পদ্মাসনে বসলেন, মুখখানি দেবীর মূর্তির দিকে৷ এখান থেকে তাঁর অনাবৃত পিঠ, মুখের ডানদিকটা আর অবনত স্তনের খানিকটা অংশ দেখতে পাচ্ছিলাম৷ প্রদীপের আলোয় চকচক করছে অনির্বাণের নিস্পন্দ দেহ৷ ছেলেটা জড়বস্তুর মতো শুয়ে আছে মাটিতে৷ মনে হচ্ছে ও যেন আর বেঁচে নেই, ওখানে যেটা পড়ে আছে সেটা ওর মৃতদেহ৷
এতদূর থেকেও মন্দিরের ভেতরের ঘটনাগুলো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম৷ প্রদীপের আলো-আঁধারিতে সেই উলঙ্গিনী নারীমূর্তির ছায়া দেখে আমার চোখে যেন ধাঁধা লেগে গেল৷ মহিলার হাত-পাগুলো দেহের তুলনায় এত লম্বা হয়ে গেল কী করে? একটু আগে খোঁপা করে বাঁধা চুলগুলো ডাইনির মতো উড়ছে কেন? স্তন দুখানি এত শুষ্ক কেন?
জঙ্গলের মধ্যে এক প্রাচীন মন্দির, তার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত অদ্ভুতদর্শন দেবী, আর তার সামনে দুই নগ্ন মানুষ-মানুষীর আদিম উপাসনা, সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল আমার সামনে যেন একটা প্রাগৈতিহাসিক ছায়াছবি অনুষ্ঠিত হচ্ছে৷ এই বুঝি ঘটে যাবে একটা অঘটন, আকাশ থেকে নেমে আসবে অশরীরী কোনো…
একঝলক ঠান্ডা বাতাস আমার মুখে ঝাপটা মেরে যেতে আকাশের দিকে চাইলাম আমি৷ মাথার ওপর জমে আসা মেঘের দল এখন আরও গভীর, আরও ঘন৷ যে-কোনো মুহূর্তে ঝড় শুরু হবে৷
মহিলা প্রথমে দু’হাত তুলে প্রণাম করলেন কাউরীবুড়ির মূর্তিকে৷ তারপর সম্পূর্ণ অজানা কোনো ভাষায়, অতি উচ্চকণ্ঠে শুরু করলেন মন্ত্রোচ্চারণ৷
কাকা ফিসফিস করে বললেন, ‘‘শুনতে পাচ্ছ ভবতারণ?’’
‘‘পাচ্ছি কাকা৷ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি৷ কিন্তু ভাষাটা বুঝতে পারছি না৷’’
‘‘এ ভাষা আমাদের চেনা পৃথিবীর কোনো ভাষাই নয় ভবতারণ৷ পরাগের বুড়ো ঠাকুর্দা কী বলেছিল গোলকপুষ্পর ব্যাপারে? পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর পাতাল থেকে তুলে আনা অভিশাপ৷ পাতাল ভবতারণ, পাতাল৷ যে পাতালে এই নাগজাতির বাস৷ এ তাদেরই ভাষা, হাজার হাজার বছর ধরে এই ভাষায় তারা পুজো করে এসেছে তাদের আরাধ দেবীকে৷’’
‘‘কিন্তু…কিন্তু…এত দূর থেকে এত স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি কী করে কাকা?’’
‘‘বায়ুস্তম্ভন ভবতারণ, এই প্রাচীন বিদ্যায়…’’
কাকার কথা শেষ হল না, কারণ ততক্ষণে একটা অশরীরী দৃশ্য স্তম্ভিত করে দিয়েছে আমাদের দুজনকে৷
অনির্বাণের দু’হাত পেঁচিয়ে ধরেছে কোনো এক গুল্মলতা৷ শুধু পেঁচিয়ে ধরেছে তাই নয়, মুহূর্তে মুহূর্তে বেড়ে চলেছে তার দৈর্ঘ্য৷ মনে হচ্ছে যেন মাটির গভীর থেকে উঠে এসেছে কোন অতিদীর্ঘ মহাসর্প, ক্রমশ তা গ্রাস করে চলেছে অনির্বাণের শরীরের ঊর্ধ্বভাগ৷ সে দৃশ্য এতই অবিশ্বাস্য, এতই হাড়হিম করে দেওয়া যে আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা শীতল বিদ্যুতের ঝলক নেমে গেল যেন৷
কাকা অস্ফুটে উচ্চারণ করলেন, ‘‘গোলকপুষ্প৷’’
আমি দু’চোখে ঘোর অবিশ্বাস নিয়ে দেখছিলাম যে লতা তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমার এত পরিশ্রম, এত পরিকল্পনা, সেই মায়াবী লতা এখন হাড়িকাঠের সামনের গহ্বর থেকে উঠে এসেছে ভয়াল নিয়তির মতো৷ ক্ষণে ক্ষণে বেড়ে চলেছে তার দৈর্ঘ্য৷ মোটা কাছির মতো আষ্টেপৃষ্ঠে সে বেঁধে ফেলছে অনির্বাণের শরীর৷