উঠেছিলাম লখিমপুর ডিস্ট্রিক্টে সদানন্দ চৌধুরীর বাড়িতে, টাউনের নাম তিনসুকিয়া৷ এখন তো তিনসুকিয়া বড় শহর, উজনি বা আপার আসামের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র৷ তখন তিনসুকিয়া বড়সড় গঞ্জ ছিল বললেই চলে৷
সদানন্দকাকু ছিলেন আমার বাবার গ্রামতুতো ভাই৷ খুব দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা লোক৷ কাকুর বিধবা মা আমাদের গ্রামের বাড়িতে ঘর মোছার কাজ করতেন৷ কাকুর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেয়ে ঠাকুর্দা ওঁর পড়াশোনার ভার নেন ও তাঁরই চেষ্টায় সদানন্দকাকু গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেন৷ তারপর বিভিন্ন কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দিতে দিতে আসাম সরকারের অধীনে একটি সরকারি চাকরি জোটান৷ তখন থেকেই অবশ্য আমাদের সঙ্গে কাকুর যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে আসে৷ শুধু মাঝে মাঝে খবর পেতাম যে কাকু নিজ অধ্যবসায়ে চাকরির জায়গায় প্রভূত উন্নতি করেছেন৷
যদিও অনেকদিন ধরেই আমাদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল না, তবুও একটা চিঠি ছেড়ে দিয়েছিলাম ওঁর ডিপার্টমেন্টের ঠিকানায়৷ তবে তার ফলাফল যে অমন হবে সে অবশ্য আমি ভাবিনি৷
ট্রেন থেকে নেমে দেখি সদানন্দকাকু স্বয়ং এসে উপস্থিত৷ আমি ওঁকে অবশ্য দেখেই চিনেছি, সামান্য মোটা হওয়া আর চুলে পাক ধরা ছাড়া আর কোনো বদল নেই৷ তবে আমাকে যে উনি কী করে চিনলেন সেটা একটা প্রশ্ন বটে৷ কারণ উনি আমাকে শেষ দেখেছেন আমার বয়েস যখন আট৷ আর আমি যখনকার কথা বলছি তখন আমার বয়েস আঠাশ, প্রায় কুড়ি বছরের ব্যবধান৷ তবে সে রহস্য কেটে গেল যখন উনি বললেন যে ‘তোমাকে দেখলেই চণ্ডীদার ছেলে বলে চেনা যায় বাবা, একেবারে সেই মুখ কেটে বসানো৷’ আমার বাবার নাম ছিল চণ্ডীচরণ৷
তিনসুকিয়াতে আমাদের অফিসের ইনস্পেকশন বাংলোতে আমার বুকিং করা ছিল৷ কিন্তু কাকু আমার কোনো কথাই শুনলেন না, স্টেশন থেকে একপ্রকার জোর করেই আমাকে টেনে নিয়ে গিয়ে তুললেন তাঁদের বাড়িতে৷ বাড়ি বললে অবশ্য কমই বলা হয়, সে এক বিশাল প্রশস্ত বাংলো৷ বোঝা যায় যে কাকু এই ক’বছরের মধ্যে কম উন্নতি করেননি! তবে অত বড় বাংলোয় থাকার মধ্যে ওই তিনজনই৷ সদানন্দকাকু, তাঁর স্ত্রী অন্নপূর্ণা কাকিমা আর তাঁদের মেয়ে মাধুরী৷
আর আমার গল্প এই মাধুরীকে নিয়েই৷ গোলকপুষ্প নিয়ে তো বটেই!
আসার পর থেকেই কাকিমা আর মাধুরীর সঙ্গে আমার বেশ ভাব হয়ে গেল৷ কাকিমার বোধহয় ছেলের শখ ছিল, আমাকে পেয়ে সেই অতৃপ্ত মাতৃস্নেহ প্রায় দুর্নিবার হয়ে উঠল৷ কাকুও নিশ্চয়ই ওঁকে সবিস্তারে আমার ঠাকুর্দা আর বাবার সাহায্য করার কথা বলেছিলেন৷ ফলে দুর্বার মাতৃস্নেহ আর কৃতজ্ঞতা মিশিয়ে যে জিনিস দাঁড়াল সে আর কহতব্য নয় ভাই, ভালোবাসার অত্যাচার বললেই চলে৷ তার ওপর কাকিমার রান্নার হাতটি ছিল সোনায় মোড়া৷ তোমরা তো জানোই, ব্রহ্মপুত্রের মাছের স্বাদই আলাদা৷ আহা, প্রায় তিরিশ বছর হয়ে গেল, সেই রান্না এখনও মুখে লেগে আছে ভাই৷
মাধুরীকে দেখে প্রথম থেকেই মনে হয়েছিল ভারী ভালো এবং ঠান্ডা মেয়ে৷ ততদিনে আমি জ্যোতিষচর্চায় মোটামুটি নাম করে ফেলেছি৷ মাধুরীকে দেখেই বুঝলাম যে মেয়ে তুলারাশির জাতক, যেমন ঠান্ডা শান্ত স্বভাব, তেমনই বুদ্ধিমতী৷ খুব সম্ভবত বৃহস্পতির স্থান উচ্চ, সামগ্রিক আচার-আচরণের মধ্যে একটা ধীর এবং প্রাজ্ঞ ব্যাপার আছে৷ সব মিলিয়ে যাকে বলে বেশ প্লেজেন্ট পার্সোনালিটি৷
তবে প্রথম দিন থেকেই একটা ব্যাপার কিন্তু আমার নজর এড়ায়নি৷ মেয়েটাকে দেখে মনে হত সবসময়ই যেন একটা আলগা বিষাদের চাদর গায়ে জড়িয়ে রেখেছে৷ ম্রিয়মাণ মুখ, মরা চাউনি৷ যেন বুকের মধ্যে কোথাও একটা চাপা কষ্ট লুকিয়ে রেখেছে৷
এদিকে আমার কাজ এগোচ্ছিল খারাপ না৷ সদানন্দকাকুর বাড়ি তিনসুকিয়া টাউনের একটু বাইরের দিকে৷ জায়গাটার নাম গেলাপুখুরি৷ জায়গাটা একদম জঙ্গলের গা ঘেঁষে৷ পশ্চিম দিকে দু-পা হাঁটলেই সেন্ট স্টিফেন্স চার্চ আর তার পরেই এথেলবাড়ি শিবমন্দির৷ মন্দির বাঁয়ে ফেলে লিম্বুগুড়ি চার্চ ছাড়ালেই মাগুরি বিল শুরু৷
বলা বাহুল্য, সদানন্দকাকুকে আমি এখানে আসার আসল কারণটা জানাইনি৷ শুধু বলেছিলাম যে নেচার ফটোগ্রাফি আমার জীবনের একমাত্র শখ৷ এইদিকে কোনোদিন আসা হয়নি বলে আমি জঙ্গল ঘুরতে এসেছি৷
সঙ্গে চিরসাথি আসাহি ক্যামেরাটা ছিলই, ফলে ওঁদের কনভিন্স করতে বেশি বেগ পেতে হয়নি৷ আমার প্ল্যান ছিল মাসখানেকের মধ্যে কোনো একটা পাত্তা লাগিয়ে কেটে পড়া৷ পরে চুপিচুপি ফিরে এলেই হল৷ ব্যাপারটা নিয়ে হইচই হোক সে আমি একদমই চাইনি৷
সে যাই হোক৷ কাজকম্ম খারাপ না এগোবার অবশ্য আরও একটা কারণ আছে৷ কাকু আমার সঙ্গে একটি স্থানীয় লোককে পার্মানেন্টলি জুটিয়ে দিয়েছিলেন, নাম ছিল মংকু৷ ছোকরাকে প্রথম দিনেই আমার বেশ পছন্দ হয়ে যায়৷ সহজ-সরল লোক, তার ওপর গত বেশ কয়েকপুরুষ ধরেই ওর পরিবার এই অঞ্চলের বাসিন্দা৷ বাপঠাকুর্দার হাত ধরে ব্রহ্মপুত্রের প্রতিটি ঢেউ থেকে শুরু করে তিনসুকিয়ার জঙ্গলের প্রতিটি গাছ চিনেছে ও৷ এই জঙ্গলে ওর থেকে ভালো গাইড আর হয় না৷
প্রথম দিন আমাকে দেখেই একটা আভূমি প্রণাম ঠুকল মংকু৷ তারপর বাঙালিঘেঁষা আসামিজ উচ্চারণে আমাকে জানাল যে এই অঞ্চলের যাবতীয় বনজঙ্গল তার নখদর্পণে৷ সে আশা করছে যে মালিকের খাস আদমির পছন্দমতো বেশ কিছু ছবি সে তুলিয়ে দিতে পারবেই পারবে৷