‘‘কিন্তু আমার হাত দিয়ে কেন?’’
প্রশ্নটা শুনে থমকালেন কাকা৷ যজ্ঞের লেলিহান শিখা তাঁর মুখের ওপর আলোছায়ার অজস্র কাটাকুটি খেলছিল৷ আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে তিনি বললেন, ‘‘কারণ এই মুহূর্তে একমাত্র ভালোবাসা ছাড়া মাধুরীকে বাঁচাবার জন্য আমাদের হাতে আর কিছুই নেই ভবতারণ৷ জেনে রেখো, ভালোবাসাই হল সবচেয়ে বড় তন্ত্র, সবচেয়ে বড় জাদু৷’’
* * * *
আমরা অপেক্ষা করছি মন্দির থেকে একটু দূরে, কয়েকটা গাছের আড়ালে৷ এখান থেকে মন্দিরের ভেতরের অনেকটা বেশ স্পষ্ট দেখা যায়৷ আমি বলতে আমি আর কাকা৷ পরাগ আছে একটু দূরে, মন্দিরের কাছাকাছি৷ কথা আছে যে আমাদের মিশন শেষ হলে আমি আর ও মিলে গোলকপুষ্পের লতাটা সযত্নে তুলে নিয়ে যাব৷ প্রফিটের বখরা হবে আধাআধি৷
যজ্ঞ শেষ হয়েছে কয়েক ঘণ্টা হল৷ তার ভস্ম ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে মন্দিরের সামনের চাতাল জুড়ে৷ আমরা বসে আছি এই নাটকের শেষ দেখার জন্য, গোলকপুষ্প তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য তো বটেই৷
ঘড়ি বলছে এখন মধ্যরাত৷ রাতের জঙ্গল শুনেছিলাম আশ্চর্য রকমের সুন্দর হয়৷ কিন্তু এই বনভূমির অতিপ্রাকৃতিক স্তব্ধতা আমাদের বুকের মধ্যে গভীর অস্বস্তির মতো চেপে বসছিল৷ মনে হচ্ছিল চারপাশের সবকিছু যেন এক অজানা আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে আছে৷
আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি সমস্ত আকাশ লাল৷ আমাদের ঠিক মাথার ওপর মেঘের ঘূর্ণিমুখ৷ যে-কোনো মুহূর্তে প্রলয় শুরু হতে পারে৷
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটু ঢুলছিলাম বোধহয়৷ কাকা হঠাৎ করে আমাকে খোঁচা দিতে সজাগ হয়ে উঠলাম৷ মন্দিরে আসার রাস্তাটার মুখে একটা আলোর ছায়া না?
আস্তে আস্তে আলোটা বেড়ে উঠতে লাগল৷ কে বা কারা যেন আসছে ওই রাস্তা ধরে৷ পায়ের চাপে কাঠকুটো ভাঙার অতি ক্ষীণ শব্দ কানে এল৷ সমস্ত স্নায়ু টানটান সজাগ হয়ে উঠল আমার৷ ওরা আসছে তাহলে?
কিছুক্ষণের মধ্যেই সুঁড়িপথ বেয়ে অনির্বাণ বেরিয়ে এল জঙ্গল থেকে, হাতে একটা বড় টর্চ৷ মন্দিরটা চোখে পড়তেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে৷ সামান্য দুলছে ওর অবয়ব৷ ছেলেটা নেশা করেছে নাকি?
ধীরে ধীরে তার পাশে অলঙ্ঘ্য নিয়তির মতো ফুটে উঠল কার যেন অবয়ব৷ খিলখিল হাসির সঙ্গে ভেসে এল একটা প্রশ্ন, ‘‘কী রে ভাই, থেমে গেলি কেন?’’
‘‘এ…এটা কোথায় এলাম দিদি?’’
‘‘তুই ছোটবেলায় বারবার জিজ্ঞেস করতি না’’, আবার সেই খুনখুনে খিলখিল স্বর, ‘‘আমি মাঝে মাঝে সারাদিনের জন্য কোথায় যাই?’’
‘‘এইখানে আসিস তুই? এই জঙ্গলের মধ্যে?’’ অনির্বাণের স্বরের মধ্যে স্খলিত ভাব স্পষ্ট৷ ও কি নেশা করেছে?
‘‘হ্যাঁ রে অনি, আমি এখানেই আসি যে৷ মাও এখানেই আসত৷ দিদিমাও৷ দিদিমার মা৷ তার মা৷ আমরা সব্বাই আসতাম এখানে৷ চুপিচুপি৷ কাউকে না জানিয়ে৷’’
‘‘ক্কে…কেন? এ…এখানে আসত কেন?’’
‘‘মায়ের পুজো দিতে ভাই৷ মায়ের আদেশ ছিল যে৷’’
‘‘কীসের আদেশ? কোন মায়ের পুজো?’’
‘‘ওই যে মন্দিরটা দেখছিস ভাই, ওটা কীসের মন্দির জানিস?’’
‘‘ন্না…ন্না তো৷’’
‘‘আমাদের মায়ের মন্দির৷ সবার মায়ের মন্দির৷ কাউরীবুড়ির মন্দির৷’’
‘‘কাউরীবুড়ির মন্দির? কাউরী মানে তো কাক…কাকেদের আবার মন্দির হয় নাকি?’’
কথা বলতে বলতে দুটো ছায়া হেঁটে যাচ্ছিল মন্দিরের দিকে৷ অনির্বাণের পরনে একটা ধুতি আর উড়নি৷ পাশের খর্বকায় দেহটি চিনতে আমার বিন্দুমাত্র ভুল হয়নি৷ আজও মহিলার কোমরে একটি বেতের চুবড়ি৷ সেদিনের কথা মনে পড়তেই আমার সারা শরীরে একটা শিহরন খেলে গেল৷
দুজনে যখন চত্বরটার মাঝামাঝি, হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে পড়লেন মহিলা৷ দেখাদেখি দাঁড়িয়ে পড়ল অনির্বাণও৷ কিছু জিজ্ঞেস করল দিদিকে৷ ভদ্রমহিলা জবাব দিলেন না৷ এদিক-ওদিক তাকিয়ে কী যেন খুঁজলেন৷ আকাশের দিকে মুখ তুলে কী একটা শোঁকার চেষ্টা করলেন৷ তারপর ওইখানে দাঁড়িয়েই চারিপাশটা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে থাকলেন৷ যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম, ঠিক সেখানে এসে দৃষ্টিটা থেমে গেল৷
বুকটা ধড়াস ধড়াস করছিল আমার৷ মহিলা বুঝতে পেরে গেলেন নাকি? ঠোঁটের কোণে একটা হাসি ফুটে উঠল না?
নাহ, চারিদিকটা দেখে আবার মন্দিরের দিকে চলতে শুরু করলেন তিনি৷ সঙ্গে সঙ্গে অনির্বাণও৷ ওর অবিন্যস্ত হাঁটাচলা দেখে বোঝাই যাচ্ছিল ও নিজের বশে নেই৷ যেন পুতুলের মতো ওকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বধ্যভূমির দিকে৷
মন্দিরের মধ্যে দুজন অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আলো জ্বলে উঠল সেখানে৷ এখান থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম যে দেবীমূর্তির পায়ের সামনে জ্বলে উঠেছে দুটি বিশাল মাটির প্রদীপ৷ আরও দুটি বড় প্রদীপ জ্বেলে দেওয়া হল মন্দিরের কোনায়৷ তাদের আলোয় দুটি দীর্ঘ ভূতুড়ে ছায়া খেলে যাচ্ছিল মন্দিরের দেওয়ালে৷
এবার পুজো শুরু হল৷ কিন্তু আজকের পুজো আগের দিনের পুজোর থেকে আলাদা৷
মূর্তির সামনে একে অন্যের দিকে মুখ করে বসল দুজন৷ প্রথমে মহিলা চুবড়ি থেকে একটা মাটির ভাঁড় তুলে নিলেন, একটা কাচের বোতল থেকে তাতে ঢেলে দিলেন কিছু তরল৷ তারপর সেটা খাইয়ে দিলেন অনির্বাণকে৷ অনির্বাণ পুরো ভাঁড়টা এক নিমেষে খালি করে পাশে ছুড়ে দিল৷ চোখ বুজে বসে রইল কিছুক্ষণ৷ তারপর দেখলাম ওর মাথাটা ঝুঁকে পড়ল বুকের কাছে৷