‘‘তাহলে?’’
স্নিগ্ধ হেসেই গম্ভীর হয়ে গেলেন কাকা৷ তারপর বললেন, ‘‘এ বড় জটিল খেলা বাবা, বড় সহজ নয়৷ ওই মহিলা অতি উচ্চস্তরের তান্ত্রিক৷ পাতরগোঁয়্যাদের বড়দেওরিরা প্রত্যেকে উত্তরাধিকার সূত্রে তাই-ই ছিলেন, তন্ত্রসিদ্ধা যোগিনী৷ বৈধব্য তাঁদের অলংকার, গোলকপুষ্প তাঁদের আয়ুধ৷
শোনো ভবতারণ, যে ফুলের খোঁজে তুমি এখানে এসেছ তার নাম গোলকপুষ্প কেন ভেবে দেখেছ? শোনো, তার পেছনে একটি কারণ আছে, সে কারণ বড় গুহ্য, বড় গোপন৷ জেনে রাখো, তন্ত্রশাস্ত্র মতে প্রতিটি রমণীর রজঃ বা ঋতুরক্তের গুরুত্ব অসীম৷ এই রজঃ স্ত্রীবীজ হিসেবে কল্পিত, তন্ত্রের ভাষায় বলে খ-পুষ্প৷ এই খ-পুষ্প দেবীর কাছে অতি পবিত্র৷ সবচেয়ে পবিত্র হচ্ছে অক্ষতযোনি বালিকার প্রথম রজঃ৷
এই প্রতিটি রজঃরক্তের ভিন্ন ভিন্ন নাম আছে৷ কুমারীর রজের নাম স্বয়ম্ভূকুসুম, চণ্ডালীর রজের নাম বজ্রপুষ্প, সধবার কুণ্ডোদ্ভব এবং বিধবার রজঃরক্তের নাম গোলোকপুষ্প!’’
আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম৷ আমার সমস্ত ধারণা ওলটপালট হয়ে যাচ্ছিল৷ গোলকপুষ্প মানে বিধবার রজঃরক্ত? এই লতা বা ফুলের সঙ্গে মাধুরীর সঙ্গে মাধুরীর ওপর নেমে আসা অভিশাপের কোনো সম্পর্ক নেই? তার মানে ওই মহিলা তাঁর…
‘‘হ্যাঁ ভবতারণ, উনি তাঁর নিজের ক্রিয়ামন্ত্রঃপূত রজঃরক্ত মিশিয়ে দিয়েছিলেন মাধুরীর সিঁদুরে৷ আর সেই থেকেই এই অনর্থের শুরু৷’’
ইতিমধ্যে পরাগ ব্যাগ থেকে আরও কিছু জিনিসপত্র বার করে রাখল কাকার সামনে৷
কাকা তার মধ্য থেকে কিছু ছোট ছোট কাঠের টুকরো বিশেষ পদ্ধতিতে যন্ত্রের ঠিক মাঝখানে স্তূপাকৃতি করে রাখলেন৷ সঙ্গে সঙ্গে মৃদুস্বরে মন্ত্রোচ্চারণ চলতে লাগল,
‘‘পাতর্যা স্যাৎ কুমারী কুসুমকলিকয়া জাপমালাং জপন্তী,
মধ্যাহ্নে প্রৌঢ়রূপা বিকসিতবদনা চারুনেত্রানিশায়াম্৷
সন্ধ্যায়াং বৃদ্ধরূপা গলিতকুচযুগা মুণ্ডমালাং বহন্তী
সা দেবী দেবদেবী ত্রিভুবনজননী কালিকা পাতু যুষ্মান্…’’
সমস্ত উপচার শেষ হলে যজ্ঞকাঠে অগ্নিসংযোগ করলেন কাকা৷ দপ করে জ্বলে উঠল যজ্ঞানল৷ তাতে একে একে আহুতি দিলেন চন্দনচর্চিত জবাফুল, মুঠিভরা আতপচাল, যজ্ঞডুমুরের কাঠ৷ সঙ্গে চলতে লাগল উচ্চৈঃস্বরে মন্ত্রপাঠ,
‘‘ভ্রূভঙ্গী ভীমবক্ত্রা জঠরহুতভুজং ভীষণং তর্পয়ন্তি, চণ্ডী স্ফেংকারাকারা টকটকিতহসা নাদসংঘট্টভীমা৷ লোলা মুণ্ডাগ্রমালাল ললহ লহা-লহা লোল লোলোগ্রবাচং, চামুণ্ডা চণ্ডমুণ্ডং মটমটমটিতং চর্বয়ন্তী পুনাতু…’’
যজ্ঞাগ্নি থেকে এবার আগুনের সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসছিল ধোঁয়ার কুণ্ডলী৷ সেই ধোঁয়া আর মশালের আগুনে কাকার মুখখানি সিল্যুয়েটের মতো দেখাচ্ছিল৷
এরপর কাকা আগুনে আহুতি দেওয়ার জন্য হাতে তুলে নিলেন কালোমতো কী একটা৷ আগুনের কাছাকাছি আনতে সেই আলোয় চিনতে পারলাম জিনিসটা কী৷ কাকের পালক!
ধোঁয়ার গন্ধ ক্রমেই কটু থেকে কটুতর হয়ে উঠছিল৷ চোখ জ্বলছিল আমার, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল৷ কাকার অবশ্য তাতে কোনো বিকার ছিল না৷ মন্ত্রপাঠ করতে করতে ঘি, দুধ আর মধু আহুতি দিলেন যজ্ঞে৷ তারপর হাতে আরেকটা কিছু তুলে আনলেন৷ আমি প্রথমে বুঝতে পারলাম না সেটা কী জিনিস৷ কাকা জিনিসটা যজ্ঞকুণ্ডের কিছুটা কাছাকাছি আনতে আমিও একটু ঝুঁকে এগিয়ে এলাম৷ কী ওটা? একটুকরো কাপড় নাকি?
হ্যাঁ, তাই তো! কিন্তু সে কাপড়ে শুকনো রক্তের দাগ কেন?
মুহূর্তের মধ্যে চোখের সামনে থেকে একটা পর্দা সরে গেল৷ আমি বুঝতে পারলাম ওটা কীসের রক্ত৷
ওটা রজঃরক্ত, মাধুরীর মেনস্ট্রুয়েশনের রক্ত৷
কাকা আজ সকালে সেটা সংগ্রহ করে এনেছেন ওর থেকে৷
হঠাৎ করেই যেন আশপাশের তাপমাত্রা কমে গেল খানিকটা৷ মাথা তুলে দেখি আকাশের বুকে জমে এসেছে ঘনঘোর মেঘপুঞ্জ৷ মন্দিরের ঠিক মাথার ওপর লালচে মেঘের দল ঘূর্ণির মতো জমাট বাঁধছে৷ ওদিকে মন্দিরের চারিপাশের বন আগের মতোই একেবারে স্তব্ধ৷ রন্ধ্রে রন্ধ্রে বুঝতে পারছিলাম যে মহাপ্রলয় আসন্ন৷
কাপড়ের টুকরোটা আহুতি দিতেই আগুনের দলা যেন লাফিয়ে উঠল আমাদের মাথার ওপর, সঙ্গে সঙ্গে একটা সাপের হিসহিসানির শব্দ৷ ফট করে কিছু একটা ফাটার আওয়াজ ভেসে এল আগুনের ভেতর থেকে৷ আর তারপরেই একটু আগের কটুগন্ধটা সরে গিয়ে একটা অদ্ভুত গন্ধে ভরে গেল চারিপাশ৷
গন্ধটা আমার খুব চেনা৷ ভিজে কাঠ পোড়ার ভ্যাপসা, শ্বাসরুদ্ধকর একটা গন্ধ৷
এইবার কাকা যেটা করলেন সেটার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না৷ একটা ছোট্ট জিনিস ব্যাগ থেকে বার করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘‘এই শেষ আহুতি ভবতারণ, আর সেটা তোমার হাত দিয়েই দিতে হবে৷ চোখ বন্ধ করো, আর আমার সঙ্গে আবৃত্তি করো, ‘দিগবাসা কৌতুকেন গ্রসতি জগদিদং যা মহাধূম্রবাসা…’’’
হাতের তেলো খুললাম, দেখি মাধুরীর সেই দিদুনের দেওয়া মাদুলি!
‘‘এ কী কাকা? এ তো মাধুরীর দিদুনের দিয়ে যাওয়া…’’
‘‘হ্যাঁ ভবতারণ৷ ওকে আহুতি দাও ওই অগ্নিতে, সমর্পণ করো৷’’
‘‘কিন্তু কাকা, এ তো মাধুরীর রক্ষার জন্য…’’
‘‘ওর প্রয়োজন ফুরিয়েছে ভবতারণ৷ অপার ভালোবাসা আর অক্ষয় যোগবিভূতি দিয়ে তিনি যে রক্ষাকবচ বানিয়ে দিয়ে গেছিলেন, আজই তার অন্তিম এবং চূড়ান্ত প্রয়োগের দিন৷ আজকের জন্যই ওকে তৈরি করা হয়েছিল…’’