‘‘ইনি কে ঠাকুর?’’ প্রশ্ন করল পরাগ৷ তার প্রাথমিক কাঁপুনি কমেছে তখন৷
‘‘মা যে দেশে দেশে বিভিন্ন রূপে প্রকাশিত হয়েছেন পরাগ৷ সে সাগরপারের দেশই হোক, বা ঘরের পাশের ঘর৷ একদিকে কৃষ্ণবর্ণা মাতৃমূর্তি রূপে অন্যদিকে করালবদনী মৃত্যুদেবী—এই দুই রূপেই দেবী প্রকটিত হয়েছেন বারে বারে৷ ইনিও মায়ের আরেক রূপ পরাগ৷ ইনি মহাপরাক্রমশালী নাগজাতির আরাধ্যা দেবী৷’’
‘‘কিন্তু কাকা, নাগ বলতে তো সাপ…’’
‘‘না ভবতারণ৷ নাগ বলতে সাপের টোটেম বা চিহ্নধারী জাতি বোঝায়৷ মহাভারতে এঁদের উল্লেখ আছে৷ অর্জুন নাগরাজ কৌরব্যের কন্যা উলূপীর পাণিগ্রহণ করেছিলেন৷ তাঁদের ইরাবান নামে এক পুত্র ছিল৷’’
‘‘কিন্তু কাকা, তার সঙ্গে এই পাতরগোঁয়্যা বা দেওরিদের সম্পর্ক কী?’’
‘‘আছে ভবতারণ, গভীর সম্পর্ক আছে৷ নাগজাতি প্রাচীন ভারতের এক অতি বলশালী নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী৷ ভেষজবিদ্যা, বিশেষ করে বিষবিজ্ঞানে এঁদের সমকক্ষ আর কেউ ছিলেন না৷ এঁরা একসময় সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে ছিলেন৷ তক্ষক নাগের নাম থেকেই তক্ষশীলার নামকরণ৷ মহারাজ নলের সঙ্গে যে কর্কোটক নাগের সাক্ষাৎ হয় তিনি ছিলেন নিষধদেশীয়, বর্তমানে বিদর্ভের কাছাকাছি৷ ওদিকে মহাভারতে যে উলূপী অর্জুনের ঘরণী হন তিনি ছিলেন প্রাগজ্যোতিষপুরের৷
মহাভারতের বহু আগেই ভারত জুড়ে নাগজাতির প্রব্রজন শুরু হয়৷ আমার ধারণা এই নাগজাতিরা পরে বর্তমান ব্রহ্মদেশ ও ভারতের সীমান্তবর্তী পার্বত্য অঞ্চলে বসবাস শুরু করে৷ আজ থেকে দেড়-দু’হাজার বছর আগে তাদেরই এক অংশ আসামে এসে দেওরি নামে পরিচিত হয়৷ খুব সম্ভবত তখন যে কটি ভেষজবিদ্যা ও ঔষধিলতা তাঁরা নিয়ে আসতে পেরেছিলেন, এই গোলকপুষ্প তার অন্যতম৷
আর নিয়ে আসেন তাঁদের আরাধ্যা এই দেবীকে৷ ইনি মহাতেজা, মহাঘোরা, মহামোহনাশিনী৷ ইনি মহাকালের মতো কর্কশ, মৃত্যুর মতো অমঙ্গলজনক, জগতের ভোগতৃষ্ণার সংহারক৷’’
‘‘কিন্তু কাকা, কে এই দেবী?’’
ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন কাকা৷ টর্চের আলোয় তাঁর চোখ দুখানি জ্বলজ্বল করছিল৷ গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘‘এখনও বোঝোনি ভবতারণ? মাধুরী সামনে এলে শ্মশানধূমের গন্ধ পাও কেন ভবতারণ, ভেবেছ কখনও? মাধুরীর স্বপ্নে এত কাক কেন? কাউরীবুড়ির মন্দিরে যাওয়ার পথে এত কাক কেন? পাতরগোঁয়্যাদের বড়দেওরির প্রথম সন্তান জন্মাবার পর বিধবা হতে হত কেন? এত মৃত্যু কেন? এত বৈধব্য কেন? এত অভিশাপ কেন? এত হাহাকার কেন? এখনও বোঝোনি?’’
যে সন্দেহটা আমার মনের কোণে জমে উঠেছিল, সেটা আর আটকে রাখা গেল না, ‘‘ইনি কি…ইনি কি…’’
‘‘হ্যাঁ ভবতারণ, ইনিই দেবী ধূমাবতী৷’’
কাকা চুপ করার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের টর্চগুলোও নিভে গেল৷ চারিদিকে নিরেট পাথুরে অন্ধকার৷ তার ঊর্ধ্ব বা অধঃ নেই, সীমাও নেই, দিক নেই, মাত্রাও নেই৷
‘‘পরাগ’’, মন্দিরের মধ্যে গমগম করে উঠল কাকার কণ্ঠস্বর৷ ‘‘যজ্ঞস্থল প্রস্তুত করো৷’’
পরাগের সঙ্গে আমরা বাইরে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালাম মন্দিরের দরজার ঠিক সামনে, দেবীমূর্তির দিকে মুখ করে৷ পরাগ সঙ্গে আনা ব্যাগটা থেকে কতগুলো ছোট ছোট মশাল বার করে একটু দূরে দূরে মাটিতে গুঁজে জ্বালিয়ে দিল৷ তারপর সেখান থেকে কাকা বেশ কিছু জিনিস বার করে মাটিতে রাখতে শুরু করলেন৷ সব সাজানো হয়ে গেলে, একটি আধপোড়া কাঠ তুলে নিলেন প্রথমে৷
আমি প্রশ্ন করলাম, ‘‘এটা কী কাকা?’’
‘‘অর্ধদগ্ধ নিমকাঠ৷ চণ্ডালের চিতা থেকে তুলে আনা৷’’
পরাগ কিছুটা বালি ছড়িয়ে দিয়েছিল মাটিতে৷ কাকা সেখানে ওই আধপোড়া নিমকাঠ দিয়ে প্রথমে একটা বৃত্ত আঁকলেন৷ তারপর তার পরিধি বরাবর আটটা পাপড়ি৷ তার বাইরে আরও একটি বৃত্ত আঁকলেন, তার পরিধি বরাবর আঁকলেন ষোলোটি পাপড়ি৷ তারপর চারিদিকে একটি চতুর্ভুজ ক্ষেত্র এঁকে সেটিকে বদ্ধ করলেন৷
‘‘এটা কী আঁকলেন কাকা?’’
‘‘ধূমাবতী যন্ত্রম৷ আজ এই যন্ত্রে আমি দেবী ধূমাবতীকে আহ্বান জানাব, প্রার্থনা করব তাঁর আশীর্বাদ৷ দেবী ধূমাবতী সাধকের সাধনায় তুষ্ট হলে তার শত্রুক্ষয় করেন, অপশক্তির নাশ করেন৷ আজ মধ্যরাত্রে এইখানে মাধুরীর দিভাই নিজের ভাইকে নিয়ে যক্ষিণীসাধনে বসবেন৷ আর একবার যদি সেই যক্ষিণীচক্র সফল হয়, তাহলে জেনে রেখো ভবতারণ, শুধু মাধুরী নয়, তার পরিবার সবংশে নিহত হবে৷ বংশে বাতি দেওয়ার মতো কেউ থাকবে না৷’’
‘‘কিন্তু তার প্রতিবিধান কী কাকা?’’
‘‘এর একটাই প্রতিবিধান ভবতারণ, বিষস্য বিষৌষধম৷ এই নাগরমণী যে মহাবিষ মাধুরীর ওপর প্রয়োগ করেছে, তাকে নিষ্ক্রিয় করতে হবে৷ তাহলেই সেই মহাবিষ প্রত্যাখ্যাত হয়ে আছড়ে পড়বে প্রয়োগকারীর ওপরেই৷ তবেই মাধুরী বাঁচবে, বাঁচবে তার পরিবার, তার কাছের লোকজন৷’’
‘‘কী সেই বিষ কাকা? কী উপায়ে সে অসম্ভব সম্ভব হবে?’’
‘‘যে বিষ ওই ক্রুরকর্মা মহিলা মাধুরীর সিঁদুরে মিশিয়েছে৷ গোলকপুষ্প৷’’
মনে হল রাত্রি যেন আরও গাঢ় হয়ে নেমে এল আমার চারিপাশে৷ যে মহার্ঘ ঔষধি নিয়ে আমি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছি, মাধুরীর সিঁদুরে মেশানো হয়েছে তারই বিষ? আমাকে ভবিষ্যতের স্বাচ্ছন্দ্য কিনতে হবে মাধুরীর সর্বনাশের বিনিময়ে?
মশালের আলোছায়া খেলে যাচ্ছিল আমার মুখে৷ কাকা আমার দিকে তাকিয়ে বোধহয় বুঝলেন আমি কী ভাবছি৷ তারপর বললেন, ‘‘ভুল করছ ভবতারণ৷ মনে মনে যা ভাবছ তা নয়৷’’