জল থেকে মাথা তুললাম৷ অনির্বাণের ওই শেষ কথাগুলো এখনও আমার কানে বাজছে৷ একটা অক্ষম ঈর্ষার বিষ যেন বুকের মধ্যে ফণা তুলে দাঁড়াতে চাইছে৷
মাথাটা তুলে একবার মেঘে ঢাকা আকাশটা দেখে নিলাম আমি৷ অমাবস্যার রাত থেকে নেমে আসা কঠিন শৈত্য আমার সমস্ত শরীর অজগরের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরেছে৷ এক ফলহীন আশাহীন কর্মের ভার পাথরের মতো চেপে বসছিল আমার বুকে৷ আমি জানি আজ এই অভিযানে আমার জয় হোক বা পরাজয়, মাধুরী আমার হবে না! হয়তো এই গোলকপুষ্পের লতা আমার জীবন গড়ে দেবে, কিন্তু সেই জীবনে মাধুরী থাকবে না৷
আজ স্পষ্ট করে বুঝতে পারছিলাম, আমি ওই সর্বনাশীর প্রেমে পড়েছি!
পাড়ে ওঠার পর একটা করে গামছা আর পরিষ্কার ধুতি আমাদের দিকে এগিয়ে দিলেন কাকা, আদেশ করলেন, ‘‘পরে নাও৷’’
কাপড় পরার পর মনে হল উত্তুরে হাওয়া যেন জমাট বেঁধে আছড়ে পড়ছে আমার বুকে৷ শিউরে উঠলাম আমি৷ কাকা বুঝতে পারলেন আমাদের অবস্থাটা৷ হাতে ছোটমতো কী একটা দিয়ে বললেন, ‘‘চিবিয়ে নাও, আরাম পাবে৷’’
অন্ধকারে বুঝতে পারছিলাম না কী দিলেন কাকা৷ মনে হল শেকড়জাতীয় কিছু৷ মুখে ফেলে চিবোনো শুরু করতেই বুঝলাম একটা ওম ধীরে ধীরে শিরা আর ধমনি বেয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেহে৷
তিনজনে এগোচ্ছিলাম আমার দেখিয়ে দেওয়া রাস্তা ধরে৷ সবার হাতে বড় পাঁচ সেলের টর্চ৷ পরাগের হাতে একটা বড় ব্যাগ৷ ঝিঁঝির শব্দে ডুবে আছে অন্ধ চরাচর৷ নাম-না-জানা কোনো জংলি ফুলের মৌতাতে পাগল হয়ে আছে বনভূমি৷ আকাশ থেকে গুরু গুরু ডাক ভেসে আসছে মাঝে মাঝে৷ জঙ্গলের পাতা বিছোনো মাটি থেকে একটা জলীয় ভাপ উঠে আসছিল কোমর অবধি৷
সবার সামনে আমি৷ কাকা আমার পেছনেই ছিলেন৷ শুনলাম বিড়বিড় করে মন্ত্রোচ্চারণ করছেন তিনি, ‘‘ওঁ নমঃ কালরাত্রি শূলহস্তে মহিষবাহিনি/ রুদ্রকালকৃত শেষয়ে আগচ্ছ আগচ্ছ ভগবতি/অতুলবীর্য্যে সর্বকর্মাণি মে বশং কুরু কুরু…’’
চলতে চলতে এবার সেই শুখানালাটা এল৷ আগের বারে যেখান দিয়ে নেমেছিলাম সেখান দিয়ে না নেমে ফিরে আসার রাস্তাটার দিকে এগোলাম৷ একটু পরেই পৌঁছোলাম সেই গাছের গুঁড়ি ফেলা সেতুর কাছে৷
‘‘ঠাকুরমশাই…’’ পরাগের ভয়ার্ত স্বর শুনে পেছনে ফিরলাম৷ আধা অন্ধকারেও স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে ছেলেটা৷ আজন্মলালিত সংস্কার পা টেনে ধরেছে ওর৷
‘‘চিন্তা কোরো না পরাগ৷ আমি আশ্বাস দিচ্ছি, তোমার কিচ্ছু হবে না৷’’
তিনজনে ধীরে ধীরে সেতুটা পার করে ওদিকে পৌঁছোলাম৷
আগের বারের মতোই ফেলে আসা বনভূমি আর আমাদের মধ্যে গাঢ় স্তব্ধতা দিয়ে বোনা শীতল ভারী পর্দা নেমে আসছিল ধীরে ধীরে৷ চারিদিক অবিশ্বাস্য রকমের চুপচাপ৷ পাতা নড়ার, বাতাসের ফিসফিস, ঝিঁঝির ডাক, রাতচরা পাখিদের কর্কশ স্বর, কিছুই ভেসে আসছিল না৷ মনে হচ্ছিল প্রকৃতি যেন নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গেছে৷ সেই গভীর রাত্রির যেন কোনো সাড় নেই, স্পন্দন নেই, প্রাণ নেই৷ শুধু আছে এক পাষাণবৎ নিষ্ঠুর নীরবতা৷
কাকা চাপাস্বরে বললেন, ‘‘বায়ুস্তম্ভ৷ প্রকৃতিবন্ধন৷ এ বড় সহজ ঠাঁই নয় ভবতারণ, যা ভেবেছিলাম তার থেকেও অনেক জটিল৷ আমাদের চেনাজানা তন্ত্রপদ্ধতির থেকে বহু সহস্র গুণ শক্তিশালী কোনো মন্ত্রে এই সমগ্র স্থানটি বন্ধন করে রাখা আছে৷ অতি প্রাচীন, কয়েক সহস্র বছরের সঞ্চিত এই মন্ত্রজ্ঞান৷ আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে, আরও সাবধান হতে হবে৷’’
এতক্ষণ ধরে বুকের মধ্যে চেপে রাখা দুরুদুরু ভাবটা এবার দ্রিমিদ্রিমি হয়ে বাজতে লাগল৷ কারণ আমি জানি এরপর কী হবে, অন্ধকার থেকে উঠে আসবে কাউরীবুড়ির অনুচরেরা, আর উড়ে এসে বসবে সামনের গাছের ডালে৷
অথচ আমাকে অবাক করে সেরকম কিছুই ঘটল না!
কথাটা কাকাকে বলতে কাকাও চিন্তিত স্বরে বললেন, ‘‘কোথাও কিছু একটা গণ্ডগোল হচ্ছে ভবতারণ, আমাদের কোনো একটা হিসেব মিলছে না৷ নইলে এরকম তো হওয়ার কথা নয়৷’’
একরাশ অনিশ্চয়তা আর ভয় নিয়ে পা বাড়ালাম আমরা৷
তিনটে মানুষ হেঁটে যাচ্ছিল সেই নিঝুম নিস্পন্দ জঙ্গলের মধ্য দিয়ে৷ টর্চের আলো নিভু নিভু হয়ে আসছিল অজানা কারণে৷ পেছনের অন্ধকার ক্রমেই আরও ভয়াল, আরও নিশ্ছিদ্র, আরও শ্বাসরোধী হয়ে উঠছিল৷
টর্চ ফেলে ফেলে আমরা সুঁড়িপথ ধরে এগোচ্ছিলাম৷ এইভাবে খানিকটা এগোনোর পর দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি৷ পেছন থেকে কাকা জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কী হল ভবতারণ?’’
সামনের দিকে আঙুল তুলে দেখালাম৷
আমাদের সামনে সেই ছোট চত্বর, আর তার ওপারেই মূর্তিমান অশনি সংকেতের মতো দাঁড়িয়ে আছে পাথুরে মন্দির৷ কাউরীবুড়ির মন্দির৷
দ্রুতপায়ে মন্দিরে পৌঁছেই কাকা বললেন, ‘‘টর্চ জ্বালো ভবতারণ, মায়ের মুখখানি দেখতে দাও৷’’
দু’জোড়া টর্চের আলো গিয়ে পড়ল দেওয়ালের উলটোদিকে৷
কাকা খানিকক্ষণ তন্ময় হয়ে চেয়ে রইলেন কাউরীবুড়ির মূর্তির দিকে৷ বিড়বিড় করে বললেন, ‘‘মা যেমন স্নেহ করেন, তেমন শাসনও করেন বই কি! তাই তো মায়ের দুই রূপ, তিনি যেমন ঘোরা, তিনি তেমনই দিব্যাও বটে৷ তিনি যেমন রুদ্রাণী, তেমন তিনি কল্যাণীও৷ ভয়ের আড়ালে তিনিই অভয়া, লয়ের মধ্যে তিনিই জয়, মরণের মধ্যে তিনিই অনন্তজীবন৷ তাঁকে ভয় কী ভবতারণ?’’