টেবিলের ওপর এক গ্লাস জল রাখা ছিল৷ এক চুমুকে পুরো জলটা শেষ করল ছেলেটা৷ কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইল৷ তারপর নীচু স্বরে বলতে শুরু করল৷
‘‘আপনারা জানেন কি না জানি না, আমার বাবা কলকাতার বাঙালি হলেও, মা ছিলেন এখানকার লোক৷ বাবা সত্তরের দশকে একটা কাঠচেরাই কলের ম্যানেজারির দায়িত্ব নিয়ে চলে আসেন৷ মায়ের সঙ্গে আলাপ এখানেই, বিয়েও এখানেই৷ বাবা আর কোনোদিন কলকাতা ফিরে যাননি৷
আমার মা ছিলেন দাপুটে মহিলা৷ একবার বাবার এক কলিগ বাবার চরিত্র নিয়ে কিছু একটা মিথ্যে গুজব রটায়৷ কথাটা হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে মায়ের কানে আসে৷ মা জানতেন যে রটনাটা আদ্যন্ত মিথ্যে, তিনি ঘাস কাটার হেঁসো হাতে সেই কলিগের বাড়িতে চড়াও হন৷ সেযাত্রা মায়ের হাতে-পায়ে ধরে তারা রক্ষা পায়৷ রেগে গেলে মা সাক্ষাৎ রণচণ্ডী হয়ে যেতেন৷ একমাত্র বাবা ছাড়া আমার মা কাউকে খুব একটা রেয়াত করতেন না৷ বাবাকে ভালোওবাসতেন খুব৷ জন্মের পরে দেখেছি মা আমাদের সংসারটাকে দাঁড় করাতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন৷ বাবার একটু খরুচে বাই ছিল৷ মা-ই যতটা পারতেন সামলাতেন৷
আমি যবে থেকে বড় হতে শুরু করলাম, লক্ষ করলাম যে আমাদের বাড়িতে এমন কিছু কিছু ঘটে যা অন্য কারও বাড়িতে হয় না৷ বিষয়গুলো দেখে খুব অদ্ভুত লাগত আমার৷ যেমন ধরুন, মা প্রতি মাসেই এক-দু’দিন সারাদিনের জন্য কোথায় যেন উধাও হয়ে যেতেন৷ মানে ভোরে বেরোতেন, ফিরতেন রাত করে৷ কোথায় যেতেন, কী করতেন কেউ জানত না, এমনকি বাবাও না৷ এই কথাটা আমাদের পরিবারের মধ্যেই কঠোরভাবে গুপ্ত ছিল, বাইরের কেউ আঁচ পেত না৷ মায়ের কড়া আদেশ ছিল, এ কথা যেন ঘুণাক্ষরেও বাইরে না যায়৷
আমার দ্বিতীয় খটকা লাগে যখন বন্ধুবান্ধবদের বাড়ি খেলতে গিয়ে লক্ষ করলাম যে, আমাদের বাড়িতে পুজো হওয়া মূর্তিগুলোর সঙ্গে অন্যান্য বাড়ির মূর্তিগুলোর কোনো মিলই নেই৷ আমাদের মূর্তিগুলো সাধারণ হিন্দু দেবদেবীর মূর্তির থেকে আলাদা তো বটেই, এবং শুধু তাই নয়, তাদের মধ্যে কিছু কিছু মূর্তি এমন অদ্ভুত আর ভয়ংকর যে হঠাৎ করে দেখে ফেললে বেশ ভয় লাগে৷ এ নিয়ে একদিন মাকে প্রশ্ন করতে গিয়ে প্রচণ্ড বকা খাই৷ মা শাসিয়ে রাখেন, এই কথা যদি ঘুণাক্ষরেও বাইরে যায়, তাহলে ফল ভালো হবে না৷ এখানে বলে রাখি, আমাদের বাড়ির ঠাকুরঘরে মা আর দিদি ছাড়া অন্য কারও ঢোকা নিষেধ ছিল৷
তৃতীয় খটকা লাগে, যেদিন থেকে আমার দিদিও মায়ের সঙ্গে অমাবস্যার দিন উধাও হয়ে যাওয়া শুরু করল৷
আপনারা জানেন নিশ্চয়ই, দিদি আমার থেকে বছর পাঁচেকের বড়৷ দিদি যেদিন প্রথম মায়ের সঙ্গে যায়, তখন আমার বয়েস ছয়৷ তার আগের রাতে বাড়িতে একটা অদ্ভুত রিচুয়ালের আয়োজন করা হয়৷ পুজো নয় কিন্তু, রিচুয়াল৷ বাবা সেদিন বাড়ি ছিলেন না৷
আমি ছোট বলে আমার থাকার পারমিশন ছিল৷
ঘটনাটা ঘটেছিল মধ্যরাতে৷ মা ভেবেছিল আমি ঘুমিয়ে পড়েছি৷ কিন্তু আমি ঘুমোইনি, লুকিয়ে লুকিয়ে দরজার ফুটো দিয়ে দেখেছিলাম সেই অদ্ভুত অনুষ্ঠান৷ সেদিন বেশ কিছু অচেনা মহিলা আমাদের বাড়িতে এসেছিল৷ তাদের আর কোনোদিন দেখিনি৷ তারা দিদিকে মধ্যিখানে রেখে গোল করে ঘিরে বসেছিল৷ সারা ঘরে মোমবাতি ছাড়া আর কিছু জ্বলছিল না৷ সেই ভূতুড়ে আলোয় তারা অজানা সুরে, অজানা ভাষায় দুলে দুলে কী একটা গাইছিল৷ সেদিন আমার খুব ভয় করেছিল, ভীষণ ভয়৷
এখন আমি জানি, ওটা ছিল দিদির প্রথম মেন্সট্রুয়েশনের দিন৷
আমার মনে প্রশ্ন উঠতে শুরু করল, কোথায় যায় দিদি? মা কোথায় নিয়ে যায় ওকে? আমাকে বলে না কেন? এমন কোন জায়গায় যায় ওরা যেটা আমাকে বলা মানা?
বড় হওয়ার ওঠার সাথে সাথে দিদির সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব বলুন, ঘনিষ্ঠতা বলুন, ভালোবাসা বলুন, সব বাড়তে থাকে৷ মায়ের আচরণ দিন দিন অদ্ভুত হয়ে আসছিল, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল বাড়ির ওই অদ্ভুত মূর্তিগুলোর পুজো৷ মা মাঝে মাঝে উন্মাদ হয়ে যেতেন৷ তখন বাবাও সামলাতে পারতেন না৷ উন্মাদ হয়ে বিড়বিড় করতেন, ‘হেই রে বুড়িমা, আবার তুই ফিরে আসবি রে মাই, তোর দেওরি তোকে ফিরিয়ে আনবে রে বুড়িমাই…’
আস্তে আস্তে মা-বাবার মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে৷ এই পরিস্থিতি সামলাতে সামলাতে বাবার হার্টের রোগ ধরা পড়ে৷ ডাক্তার বলে যান বাবার ওপর যাতে বেশি স্ট্রেন না পড়ে, তাই মায়ের এই অবস্থায় বাবাকে মায়ের থেকে একটু দূরে রাখাই শ্রেয়৷ সেই থেকে মা আর বাবা আলাদা ঘরে শুতে শুরু করেন৷ এদিকে আমাদের বাড়িতে তিনটেই শোয়ার ঘর৷ আগে বাবা-মা এক ঘরে, দিদি অন্য ঘরে শুত৷ আমি দোতলার ঘরে একা শুতাম৷ বাবা আর মা আলাদা শোয়া শুরু করাতে বাধ্য হয়েই দিদিকে আমার ঘরে শুতে আসতে হয়৷
তখন দিদির বয়েস সতেরো, আমার বারো৷ আর এখান থেকেই সব সর্বনাশের শুরু৷
দুজনেরই তখন কাঁচা বয়েস৷ শরীর নিয়ে দুজনেরই অনেক কৌতূহল, অনেক জিজ্ঞাসা৷
ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল ঠাট্টা-ইয়ার্কির ছলে৷ আস্তে আস্তে গায়ে এখানে-ওখানে হাত দেওয়া, খুনসুটি করা, এইসব৷ আস্তে আস্তে শারীরিক ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে৷ আমরা জানতাম যা করছি তা ঠিক নয়৷ কিন্তু এই নিষিদ্ধ শরীরী খেলা আমাদের নেশার মতো পেয়ে বসেছিল৷ রোজ রাতের খাওয়া শেষ হলেই আমরা বিছানায় যাওয়ার জন্য উশখুশ করতাম৷