চায়ে চুমুক দিতে দিতে কাকা পরাগকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘আসবে তো?’’
‘‘একদম আসবে স্যার৷’’
‘‘পালটি খাবে না তো? তুমি শিওর?’’
‘‘হান্ড্রেড পার্সেন্ট আসবে স্যার৷ পরাগ বসুমাতারি কাঁচা কাজ করে না৷’’
‘‘কী বলে রাজি করালে শুনি?’’ কাকা চোখটা কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, ঠোঁটের কোনায় একটা হাসির আভাস৷
‘‘রাজি করাতে বেশি কষ্ট হয়নি স্যার৷ সে মক্কেল তো হাঁসফাঁস করছিল প্রায়৷ আপনার কথা খুলে বলতেই…তবে কষ্ট হয়েছে খুঁজে পেতে৷ বহুত হুজ্জোত গেছে স্যার৷’’
‘‘পেলে কোথায়? বাড়িতেই ছিল না অন্য কোথাও?’’
‘‘বাড়িতেই৷ এই চার-পাঁচ মাস প্রায় গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল৷’’
‘‘হুম, সেরকমই আন্দাজ করেছিলাম৷ তা খুঁজে পেলে কী করে?’’
‘‘হে হে হে…ওটা নাহয় সিক্রেটই থাক স্যার৷ এককালে তো এই এলাকাতেই বাস ছিল আমাদের, কিছু যোগাযোগ তো আছেই৷’’
এইবার মনে পড়ে গেল ডুমডুমা নামটা আগে কোথায় শুনেছি৷ পরাগ বসুমাতারির পূর্বপুরুষেরা আগে এই গ্রামেই থাকতেন বটে! কিন্তু এখন এখানে কেন আমরা?
বিষয়টা মাথায় ঢুকছিল না৷ সকাল সকাল এতটা রাস্তা উজিয়ে কেনই বা এখানে এলাম, আর কে-ই বা গৃহবন্দি ছিল, কার সঙ্গে দেখা করার কথা হচ্ছে, সেটা বুঝতে পারছিলাম না৷
চা খেয়ে উঠে দাঁড়ালেন কাকা, পরাগকে বললেন, ‘‘একবার খোঁজ নাও পরাগ, দ্যাখো এসেছে কি না৷’’
এতক্ষণ খেয়াল করিনি, চায়ের দোকানের পাশেই একটা ফোন বুথ৷ পরাগ সেখানে ঢুকে কাকে একটা ফোন করল যেন৷ তারপর বাইরে বেরিয়ে চাপা উত্তেজনার সঙ্গে বলল, ‘‘এসে গেছে স্যার৷ চলুন৷’’
এবার মেন রোড ছেড়ে একটা কাঁচা রাস্তা ধরলাম৷ একটু এগোতেই দেখি একটা পাড়ার মধ্যে ঢুকছি৷ হুবহু পরাগদের পাড়াটার মতো, শুধু আরেকটু ভদ্র গোছের, এই যা৷
মিনিট পাঁচেকের বাইক রাইডের পর একটা বাড়ির সামনে বাইকটা স্ট্যান্ড করে উচ্চৈঃস্বরে কাকে একটা ডাকল পরাগ৷ একটু পরেই একটি অল্পবয়সি মেয়ে বেরিয়ে এল৷ দেখেই স্পষ্ট বোঝা যায় পরাগের স্বজাতি৷ মেয়েটির মুখে একটা আলগা ভয়ের ভাব, পরাগকে দেখে হাসলেও সেটা লুকোনো গেল না৷
পরাগ কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে মেয়েটি ভেতরের দিকে ইঙ্গিত করল৷ পরাগ আমাদের দিকে ঘুরে একটু চাপা গলায় বলল, ‘‘আসুন৷’’ মংকুকে বলল, ‘‘তুই এখানেই থাক, পাহারা দে৷’’
বাড়ির ভেতর ঢুকে বুঝলাম মোটামুটি পয়সাওয়ালা লোকের বাড়ি৷ টিভি ফ্রিজ টেলিফোন সবই আছে৷ বসার ঘর থেকে ভেতরের দিকে যেতে যেতে কাকা চাপাস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘এ কাদের বাড়ি পরাগ?’’
পরাগ একটু লাজুকস্বরে উত্তর দিল, ‘‘আমার হবু শ্বশুরবাড়ি৷’’
ওরেশালা! ব্যাটা এইখানে বিয়ের কথা দিয়ে ওদিকে শিলিগুড়ির ডান্সগার্লের সঙ্গে আশনাই করে বেড়াচ্ছে? মহা খলিফা ছেলে তো!
ভাবতে ভাবতেই দেখি একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল পরাগ৷ দরজাটা ভেজানো৷ সেটা ঠেলে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘আসুন৷’’ তিনজনে ঢুকে পড়লাম ৷
ঘরের ভেতরটা বেশ অন্ধকার, চোখ সইতে একটু সময় নিল৷ এদিক-ওদিক তাকিয়ে বুঝলাম এটা বোধহয় বাড়ির এক্সট্রা ঘর, প্রয়োজনে ভাঁড়ারঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়৷ সারা ঘরে একটাই জানলা, যেদিক দিয়ে ঢুকলাম তার ঠিক উলটোদিকে৷ এখন অবশ্য ঘরে জিনিসপত্র ডাঁই করা নেই৷ তার বদলে যেটা আছে সেটা হচ্ছে জানলার ঠিক সামনে রাখা একটা টেবিল, তার ওপাশে একটা চেয়ার আর চেয়ারে বসে থাকা একটা মানুষ!
আমাদের ঘরে ঢুকতে দেখে লোকটা একটু নড়ে উঠল, কাঁপা কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করল, ‘‘পরাগ, পরাগ…উনি এসেছেন?’’
পরাগ আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলল, ‘‘হ্যাঁ দাদা, উনি এসেছেন, একদম চিন্তা করবেন না৷ এবার সব ঠিক হয়ে যাবে৷’’
সেই অল্পবয়সি মেয়েটি এসে তিনটি চেয়ার দিয়ে গেল ঘরের মধ্যে, দরজা বন্ধ করার আগে পরাগকে বলে গেল, ‘‘বেরোবার আগে আমাকে একবার ডেকে নেবেন কিন্তু৷’’
পরাগ গিয়ে জানলাটা খুলে দিল, আর বাইরে থেকে ঝাঁপিয়ে পড়া আলোয় টেবিলের ওপারে বসা লোকটাকে দেখে প্রচণ্ড চমকে উঠলাম আমি৷ পরশু এই ছোঁড়াকেই সদানন্দকাকুর বাড়ির সামনে উঁকিঝুঁকি দিতে দেখেছিলাম না?
তবে আমার অবাক হওয়ার আরও বাকি ছিল৷ কাকা একটা চেয়ার টেনে নিয়ে লোকটার সামনে বসে প্রশ্ন করলেন, ‘‘আপনার শরীর ভালো আছে তো অনির্বাণবাবু?’’
নামটা শুনে মনে হল কে যেন আমার বুকে একটা ঘুসি মারল৷ অনির্বাণবাবু? এই তাহলে অনির্বাণ চৌধুরী? মাধুরীর স্বামী?
একটা দুরন্ত ক্রোধ, একটা অবর্ণনীয় অক্ষম ঈর্ষা আমার শরীরের বাঁদিক থেকে জ্বলতে জ্বলতে মাথার ওপরের দিকে উঠতে লাগল৷ এই সেই হারামজাদা, যে নিজের দিদির সঙ্গে শুয়ে, যৌবনের সমস্ত মস্তি লুটেও একটা নিষ্পাপ মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে৷ এই সেই শুয়োরের বাচ্চা, যার পারিবারিক সম্পর্কের বোধ নেই, অন্য কারও জীবনের প্রতি মায়া নেই, বিছানায় মেয়ে তোলার ক্ষেত্রে বাছবিচার নেই৷ এই পারভার্ট জানোয়ারটাকে…
একটা থরথরে ভয়ার্ত স্বরে উত্তর ভেসে এল, ‘‘আ…আমি..আমি ভালো নেই…আমি ভালো নেই…আ…আমি..আমি বাঁচতে চাই…আমি পালাতে চাই এসব থেকে…’’
কাকা একটু সামনে ঝুঁকে লোকটার দুটো হাত ধরে ফেললেন, ‘‘আমি জানি অনির্বাণবাবু, কী ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আপনি যাচ্ছেন৷ না জানলেও অন্তত আন্দাজ করতে পারি৷ সেইজন্যই কাল পরাগকে বলেছিলাম যে করে হোক আপনার খোঁজ করতে৷ আমার আশঙ্কা ছিল যে আপনাকে হয়তো এই ক-মাস কড়া পাহারায় রাখা হয়েছে৷ এবার আপনার গল্পটা বলুন তো৷ তার ওপরেই অনেকগুলো জীবন নির্ভর করছে৷’’