মাধুরীকে মনে হল চেয়ার থেকে পড়ে যাবে এবার৷ হাতটা থরথর করে কাঁপছে৷ চাইলেও মুঠোটা খুলতে পারছে না৷ আমি উঠতে যাচ্ছিলাম সাহায্য করব বলে৷ কাকু হাত দেখিয়ে বারণ করলেন৷ মাধুরীকে আদেশ করলেন, ‘‘মাদুলিটা ওখানে রাখো মা৷’’
অনেক চেষ্টা করে মাধুরী হাতের মুঠো খুলে মাদুলিটা চক্রের মধ্যে রাখল, ঠিক সেই সময় দরজার বাইরে কে যেন গম্ভীর আর কর্কশ স্বরে ডেকে উঠল একবার, ‘ক্রা ক্রা’৷
মাধুরী অস্ফুটে বলল, ‘‘সেই লোকটা!’’
কাকু আমল দিলেন না৷ বললেন, ‘‘তোমার দুই বুড়ো আঙুল এই তারার দুটি শীর্ষবিন্দুতে রাখো মা৷ আর তোমার দিদুনের কথা ধ্যান করো৷ সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে, সমস্ত সত্তা দিয়ে, সমস্ত চৈতন্য দিয়ে৷’’
আমাকে বললেন, ‘‘ডানহাতে পইতেটা জড়িয়ে মনে মনে গায়ত্রী মন্ত্র জপ করো৷ একটি শব্দও যেন ভুলভাবে উচ্চারিত না হয়৷ তাহলে কিন্তু অনর্থ হয়ে যাবে৷’’
এবার কাকা তাঁর নিজের তর্জনী দুখানি সেই চণ্ডকাত্যায়নীচক্রের দুটি শীর্ষবিন্দুতে স্থাপন করলেন৷ আর একটি মাত্র শীর্ষ অস্পর্শিত রইল৷
সেটি চতুর্থ ফাঁকা চেয়ারটির দিকে নির্দিষ্ট৷
চোখ বন্ধ করলেন কাকা৷ গম্ভীরস্বরে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করলেন,
‘ব্যোমবক্ত্রম মহাকায়ং প্রলয়াগ্নিসমপ্রভম্৷
অভেদ্যভেদকং স্তৌমি ভূতডামর-নামকম্৷৷
আদিবীজং সমুধৃত্য ততো রুদ্রভয়ংকরী,
অট্টট্টহাসিনি সাধকপ্রিয়ে পদ্মুদ্ধরেৎ…’’
অনেক দূর থেকে একটা শোঁ শোঁ আওয়াজ কানে আসছিল৷ এবার মনে হল আওয়াজটা যেন ক্রমেই বাড়ছে৷ মনে হচ্ছে কোনো এক বিশাল দৈত্য ক্রুদ্ধভাবে দৌড়ে আসছে আমাদের দিকে৷ তার হুংকারে কান পাতা দায়— ক্কড়ক্কড়কড়াৎ করে একটা বাজ পড়ল কাছেই৷ কয়েক সেকেন্ড বাদে তার বিস্ফোরণের শব্দটা আমাদের কানে আছড়ে পড়তেই শুরু হয়ে গেল ঝড়ের দাপট৷ দরজা-জানলাগুলো ছটফট করতে লাগল পাগলের মতো৷ ঘরের চারিদিকে মনে হল প্রলয়মাতন লেগেছে৷ ঘন ঘন বজ্রপাত আর ঝড়ের অট্টহাসির জেরে কান পাতা দায়৷
আমার বুকের মধ্যে কে যেন দুরমুশ পিটছে৷ তবুও আমি চোখ বন্ধ করে একমনে গায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগলাম৷ ওদিকে কাকা উচ্চারণ করে চলেছেন,
‘‘বিষমুদ্ধৃত্যাপি সুরতপ্রিয়ে দিব্যলোচনি৷
কামেশ্বরী জগন্মোহিনী ততশ্চ সুভগে পদম৷
ততঃ কাঞ্চমালেতি ভূষণীতি পদং বদেৎ৷
ততো নূপুরশব্দেন প্রবিশদ্বয়মুদ্ধরেৎ…’’
ওদিকে বাইরে প্রলয়ের তাণ্ডব বেগ ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী৷ মনে হচ্ছে কোনো বিপুল বলশালী দৈত্য যেন বুলডোজার দিয়ে বাড়িটা গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে৷ আমি মন্ত্র জপ করে যাচ্ছি বটে, কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারছি আমার হাত-পা থরথর করে কাঁপছে৷ যে-কোনো মুহূর্তে আমি মন্ত্র ভুলে যেতে পারি৷
এমন সময় একটা অজানা গন্ধ আমার নাকে এল৷ ঘি, কর্পূর, ধূপধুনো, গুগ্গল মেশানো একটা সুবাস৷ তার সঙ্গে একটা অজানা ফুলের গন্ধ৷
কাকা চাপা গলায় বললেন, ‘ব্যস৷’
চোখ খুললাম৷ তিনটি মোমবাতির আগুনই নিভু নিভু প্রায়৷ ঘরের মধ্যে কে যেন একটা ছায়া ছায়া অন্ধকারের চাদর বিছিয়ে দিয়েছে৷ আমি কাকা আর মাধুরীর শুধু অবয়ব দেখতে পাচ্ছি৷ আর দেখতে পাচ্ছি আরও একটা জিনিস৷
চণ্ডকাত্যায়নীচক্রের পঞ্চম শীর্ষবিন্দু ছুঁয়ে আছে আঙুলের মতো কীসের যেন একটা ছায়া!
লক্ষ করলাম বাইরের ঝড়ের তাণ্ডব একেবারে স্তব্ধ৷ কোথাও কোনো একটা পিন পড়ারও আওয়াজ নেই৷ কিছু একটা ঘটার প্রত্যাশায় ঘরের নৈঃশব্দ্য যেন অধীর আগ্রহে কাঁপছে৷
স্তব্ধতা বন্ধ করে প্রথম কথা বললেন কাকা, চাপা অথচ স্পষ্ট স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘মা, আপনি এসেছেন?’’
যেন কোন অতল গহ্বর থেকে থেকে এক ক্ষীণ, অতি ক্ষীণ বৃদ্ধার কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘‘আহ…বড় কষ্ট…বড় কষ্ট…কেন…কেন ডাকলে আমায়…’’
‘‘আপনার নাতনির জীবন আজ বিপন্ন মা৷ নইলে আপনাকে জীবস্তরে ডেকে আনার ধৃষ্টতা করতাম না, সন্তানের অপরাধ ক্ষমা করুন৷’’
‘‘আমি তো বলেছিলাম…ও সিঁদুর পরিসনে মেয়ে…বলেছিলাম ও সিঁদুর অলুক্ষুণে…বারণ…বারণ করেছিলাম…ও মেয়ে আমার বারণ শোনে না কেন… আমার কথা শোনে না কেন…’’
‘‘দিদুন…দিদুন…তুমি সত্যি এসেছ দিদুন…’’
‘‘নিষেধ শুনিস না কেন মা…ও মাদুলি কেন খুললি…ও শয়তানির দেওয়া অমঙ্গলমূর্তি কেন রাখলি ঘরে…’’
‘‘ও কীসের মূর্তি দিদুন?’’
‘‘ও মূর্তি ঘোর পাতালের অভিশাপ…ও বিদ্বেষনাগিনীর মূর্তি…ওই মূর্তি যার ঘরে থাকে তার সবকিছু ছারখার করে দেয়…তাকে তিল তিল কষ্ট দিয়ে নাশ করে…’’
‘‘কিন্তু কেন মা? কে ওর অমঙ্গল চাইছে? আর কেন?’’ এবার কাকা প্রশ্ন করলেন৷
‘‘শোন রে মেয়ে…তোর ভালোবাসার মানুষের ওপর নজর পড়েছে কালনাগিনীর…সে তার নিজের সহোদরা…তার অতৃপ্ত যৌবন কুরে কুরে তুলে এনেছে উগ্র কামবাসনার গরল৷ সে তোকে তোর শত্রু মনে করে…সে চায় তার পথের কাঁটাকে উপড়ে ফেলতে৷’’
‘‘কিন্তু কেন দিদুন…কেন?’’
‘‘সে পাপিনীর রক্তের সম্পর্কের বোধ নেই…এতই তীব্র তার অতৃপ্ত কামনার আগুন৷ কিন্তু তাকে দুর্বল বলে ভাবিসনি মেয়ে…সে বড় শক্ত ঠাঁই…সেই পাপিষ্ঠা পারে না হেন সিদ্ধাই নেই…সে চাইছে তোর ধর্মনাশ হোক, তোর সর্বনাশ হোক, তোর প্রাণনাশ হোক…’’
‘‘দিদুন…দিদুন…সেদিন তুমিই আমাকে বাঁচাতে এসেছিলে দিদুন?’’