‘‘আঙুলের রক্ত নয় মা৷ বুকের৷’’
এবার থমকাল মাধুরী৷ একবার কাকার দিকে, একবার আমার দিকে তাকাল৷ চোখ বন্ধ করল মুহূর্তের জন্য৷ তারপর বাঁদিকে খানিকটা ঘুরে গিয়ে শাড়ির আঁচলটা সরিয়ে বাম স্তনের ঠিক ওপরে কাঁটাটা ফুটিয়ে দিল৷
আমি স্বভাবতই মাথাটা নীচু করে ফেলেছিলাম৷ কাকার দেখলাম কোনো বিকার নেই৷ সহজ অথচ গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘‘বাঁ হাতের কড়ে আঙুলে এক এক করে ঠিক তিনটি ফোঁটা রক্ত এই মিশ্রণের মধ্যে ফ্যালো মা৷’’
আমার ঠিক চোখের সামনে ছিল তামার পাত্রটা৷ দেখলাম মাধুরীর চাঁপাকলির মতো আঙুল থেকে তিনবার তিনটি রক্তবিন্দু মিশে গেল সেই মিশ্রণে৷
চোখ বুজলেন কাকা৷ তারপর গম্ভীর স্বরে আবৃত্তি করলেন,
‘‘ওঁ চামুণ্ডে শ্মশানকালিকে রক্তবর্ণা ত্রিনয়না৷
ভূতাদি প্রেতাদি সঙ্গা মহারত পরায়ণা৷৷
প্রসীদ প্রসীদ দেবীভূত্যাস্তবম্মকান্৷
সর্ব্বসিদ্ধিপ্রদা দেবি সিদ্ধি সর্বত্র দেহি মে৷’’
আগে কখনও কাকাকে এইভাবে দেখিনি৷ আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল৷
এইবার কাকা আধপোড়া গোছাটা মিশ্রণে ডুবিয়ে টেবিলের ওপর একটা একটা অদ্ভুত জ্যামিতিক নকশা আঁকলেন৷ নকশাটা দেখতে অনেকটা স্টার অফ ডেভিডের মতো, তফাত হচ্ছে যে এতে ছটার বদলে পাঁচটা মাথা৷ সেই পাঁচটা মাথা ছুঁয়ে একটি বৃত্ত৷ সেই বৃত্তটিকে বেষ্টন করে আরও একটি বৃত্ত৷ এবার ওই পঞ্চমুখী তারার পাশাপাশি দুটি মাথা থেকে সমদূরত্বে দুই বৃত্তের মাঝখানে পাঁচটি ফোঁটা আঁকলেন৷ সবশেষে একটি চতুর্ভুজ আঁকলেন কেন্দ্রস্থলে৷
আমি আর মাধুরী এতক্ষণ কাকার কাজকর্ম দেখছিলাম, কিছু বলিনি৷ আমাদের মধ্যে মাধুরীই প্রথমে জিজ্ঞাসা করল, ‘‘এটা কী কাকামশাই?’’
কাকা বললেন, ‘‘এর নাম চণ্ডকাত্যায়নীচক্র মা৷ আজ আমি এই চক্রের মাধ্যমে এইখানে তোমার দিদিমার আত্মাকে আহ্বান করব৷ কাল মহালয়া৷ এই সময়ে আমাদের পূর্বসূরিরা এই জড়জগতের সবচেয়ে কাছাকাছি থাকেন৷ এই পুণ্যলগ্নে আমি সেই মহীয়সী সাধিকাকে আহ্বান জানাব আমাদের মার্গনির্দেশের জন্য, আমাদের অজ্ঞানের অন্ধকার দূর করার জন্য৷’’
‘‘কিন্তু তার জন্য এসব…’’
‘‘এই কাত্যায়নীচক্রসাধন অতি গূঢ়, অতি গুহ্যবিদ্যা মা৷ এই পৃথিবীতে মাত্র গুটিকয় সাধক এর প্রয়োগ জানেন৷ তোমার দিদিমা ছিলেন মহাসাধিকা, মহাযোগিনী৷ তাই কোনো সাধারণ চক্রাধার তাঁর আত্মার বিপুল বেগ ধারণ করতে সক্ষম নয়৷’’
‘‘কিন্তু কেন কাকামশাই? মানে এসব করে কী হবে?’’
মাধুরীর দিকে তাকালেন কাকা৷ বললেন, ‘‘মা, তুমি যে এখনও অবধি বেঁচে আছ সে তোমার ওই দিদুনের কৃপায়৷ নিজের মৃত্যু আসন্ন জেনে সেই মহাসিদ্ধযোগিনী তাঁর অলৌকিক বিভূতির খানিকটা তোমায় দিয়ে গেছিলেন, তারই জোরে তুমি এখনও নিঃশ্বাস নিতে পারছ মা৷ সেদিন মহাধর্মনাশের হাত থেকে তিনিই তোমাকে বাঁচিয়েছেন৷ নইলে তুমি যে সংকটের মধ্যে পড়েছ, এক মৃত্যু ছাড়া তার থেকে উদ্ধার পাওয়া অসম্ভব৷’’
কাকার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মোমবাতির শিখাগুলো যেন একবার লাফিয়েই স্থির হয়ে গেল৷ আর আমার ঘাড়ের ঠিক কাছে কে যেন ঠান্ডা ফুঁ দিল একটা৷ আমার সমস্ত শরীর শক্ত হয়ে উঠল৷ আড়চোখে তাকিয়ে দেখি মাধুরীও যেন ভয় পেয়েছে কিছুটা৷
কাকা লক্ষ করলেন সেটা৷ তারপর বললেন, ‘‘দুজনকেই বলে রাখি, এই চক্রসাধনপথে কিন্তু মহাবিঘ্নভয় উপস্থিত হবে৷ যে অপশক্তি এ বাড়ির আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সে কিন্তু অত্যন্ত ক্রুরকর্মা, অত্যন্ত শক্তিশালী৷ সে সর্বতোভাবে চেষ্টা করবে যাতে আমরা সফল না হই৷ তাহলেই তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ৷ এই সময় তোমরা নিজের সাহস বজায় রাখবে৷ কোনোমতেই বুদ্ধিভ্রষ্ট হবে না, তাহলেই কিন্তু মহা সর্বনাশ৷ মাধুরী মা, এইবার তোমার দিদুনের দেওয়া মাদুলিটা নিয়ে এসো৷ এই চক্রের মাঝখানে যে চতুর্ভুজটি আছে, তার মধ্যে রাখো৷’’
মাধুরী ওর মুঠোটা টেবিলের ওপর আনতেই হঠাৎ করে একটা দুম করে আওয়াজ৷ মনে হল কে যেন আমাদের ঘরের ছাদের ওপর বড় ইট বা পাথর ছুড়ে মারল একটা৷
মাধুরী থমকে গেছিল৷ কাকা দৃঢ়স্বরে বললেন, ‘‘নিজের মনোযোগ বিঘ্নিত হতে দিও না মা৷ আজ উন্মত্তভৈরব স্বয়ং আমাদের রক্ষা করবেন৷ যা বলছি সেটা করো৷’’
মাধুরী ধীরে ধীরে মাদুলিটা ওই নকশার মধ্যিখানে নিয়ে যেতে শুরু করতেই মনে হল ঘরের চারিপাশে যেন তাণ্ডব শুরু হয়েছে৷ দরজা-জানলাগুলো বিপুলভাবে কাঁপতে লাগল৷ সারা ছাদ জুড়ে কেউ যেন হাতুড়ি পিটছে উন্মত্তের মতো৷ ইতিমধ্যেই আমার হাত-পা কাঁপছে, কানের পাশ দিয়ে গড়াচ্ছে গরম ঘামের ফোঁটা, পেটের মধ্যেটা ফাঁকা৷ সমানে গুরুমন্ত্র জপে যাচ্ছি৷
মাধুরীকে দেখে বুঝলাম তারও অবস্থা আমার থেকে খুব বেশি ভালো না৷ কেবলমাত্র মনের জোরে সে তার ক্রমাগত কাঁপতে থাকা হাতটা নিয়ে যাচ্ছে নকশার দিকে৷
মাধুরীর মুঠোটা ঠিক চণ্ডকাত্যায়নীচক্রের মধ্যিখানে পৌঁছেছে, ঠিক সেই সময় সবকিছু হঠাৎ করে থেমে গেল৷ কোথাও কিছু নেই৷ চারিদিকে অপার পাথুরে স্তব্ধতা৷
তারপর শব্দটা শুরু হল৷ শুরু হল ধীরে ধীরে৷ মনে হল দরজার ওপর ধারালো নখ দিয়ে কে যেন আঁচড়াতে শুরু করেছে৷ একটা ভয় ধরানো ক্যারররররর আওয়াজ ধীরে ধীরে হিংস্র শ্বাপদের মতো আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকল অনিবার্য নিয়তির মতো৷