আমি তখন নর্থ বেঙ্গলে পোস্টেড৷ চাকরিবাকরি করি, খাইদাই আর অবসর সময়ে বিভিন্ন অজানা পাহাড়ি ভেষজের খোঁজ করি৷ সেই করতে গিয়ে ওখানকার কিছু এজেন্টের সঙ্গে আমার বেশ সখ্য হয়ে গেছিল৷ তাদের কাছ থেকে বেশ কিছু ছুটকোছাটকা খবর পেতাম ঠিকই, তবে তাতে মন ভরত না৷
সেইভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল৷ কেটে যেতও, যদি না উনিশশো নব্বই সালের আশ্বিন মাসের এক সন্ধেয় দৈবাৎ আমার হাতে একটা প্রাচীন পুথি এসে পড়ত৷
পুথিটা নিয়ে এসেছিল ওসমান, আমার শিলিগুড়ির চেনা এজেন্ট৷ নর্থ বেঙ্গল আর নর্থ-ইস্ট জুড়ে পুরোনো পুথিপত্র জোগাড় করার লাইনে ও ছিল বেতাজ বাদশা৷ আমাকে ওসমান একটা আলাদা খাতির করত৷ কারণ সেরকম সেরকম ভালো পুথি পেলে আমি উচিত দাম দিতে কোনোদিনই কসুর করিনি৷
পুথিটা একটা পুরোনো আয়ুর্বেদশাস্ত্রের পুথি৷ রচয়িতা ‘কামরূপ-দেশাগত’ জনৈক ব্রাহ্মণ, নাম রুচিনাথ বড়গোঁহাই৷ পুথিটার বয়েস কিন্তু খুব বেশি না, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ বা ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক নাগাদ লেখা, কারণ তাতে ‘বৃটিস সৈন্যপুঞ্জ’ এবং ‘লংডং যবননগরী’-র উল্লেখ আছে৷ অর্থাৎ লেখক ইংরেজ রাজত্বের ব্যাপারে সম্যক ওয়াকি-বহাল৷ সময়কালটা বুঝতে অবশ্য আরও সুবিধা হল, কারণ ভদ্রলোক তাঁর রাজ্যের রাজা হিসেবে উল্লেখ করেছেন ‘স্বর্গদেউ চন্দ্রকান্ত সিংহ’-র কথা৷ এই অহোমরাজের রাজত্বকাল আঠেরোশো এগারো থেকে আঠেরোশো আঠেরোর মধ্যে৷
পুথিটায় প্রথম দিকে তেমন কিছু ইন্টারেস্টিং পাইনি৷ সাধারণ আয়ুর্বেদিক গাছগাছালির বিবরণ, তার প্রায় সবই আমার চেনা, নতুন কিছু নেই৷ পাতা ওলটাতে ওলটাতে ভাবছিলাম ওটা ওসমানকে ফিরিয়েই দেব কি না৷
থমকে গেলাম মাঝামাঝি এসে৷ কয়েকটা পাতা পড়ে নিজের চোখদুটোকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না৷ আরিব্বাস, এ তো পুরো স্বর্ণখনি!
ওসমান খুব সম্ভবত আমার চোখমুখ দেখে কিছু একটা আন্দাজ করেছিল নিশ্চয়ই, নইলে হঠাৎ করে অমন একটা সাধারণ পুথির দাম হাজার টাকা হেঁকে বসবে কেন? তখনকার দিনে হাজার টাকার দাম অনেক৷ তবুও বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে টাকাটা ওসমানের হাতে তুলে দিলাম৷’’
‘‘কেন? তাতে কী ছিল চাটুজ্জেমশাই?’’ প্রশ্নটা বংশীই করল বটে৷ তবে আমাদের সবার মনেও তখন ওই একই জিজ্ঞাসা৷
সামনে রাখা চায়ের ভাঁড়ে একটা চুমুক দিয়ে ফের শুরু করলেন চাটুজ্জেমশাই, ‘‘যা ছিল আমার কাছে তখনই তার দাম লাখ টাকার সমান৷ সেটি হচ্ছে গোলকপুষ্প নামে একটি অতি দুষ্প্রাপ্য ভেষজলতার উল্লেখ৷
এই গোলকপুষ্পের উল্লেখ এর আগেও এক-দু’ জায়গায় পেয়েছি, তবে তা সবই ভাসা ভাসা৷ শুধু জানতে পেরেছিলাম যে গোলকপুষ্প পাওয়া যায় উত্তর আসামের জঙ্গলে৷ ডিব্রুগড় থেকে শুরু করে ধুবড়ির মাঝামাঝি কোনো এক জঙ্গলের মধ্যে৷ তার নাকি অনেক গুণাগুণ, বিশেষ করে এর রস নাকি যাবতীয় যৌন রোগের অব্যর্থ দাওয়াই৷
ওসমান চলে যেতেই চট করে রাতের খাওয়াটা সেরে পুথিটা নিয়ে চৌকিতে লম্বা হলাম৷
আগাগোড়া সংস্কৃতে লেখা পুথি, বেশি বড় নয়৷ পুরোটা পড়ে ফেলতে সময় লাগল ঘণ্টা দুয়েকের সামান্য বেশি৷
পড়তে পড়তে ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে উঠছিলাম৷ পুথিতে এই ভেষজের গুণাবলির ব্যাপারে যা যা পড়লাম সেসব যেমনই আশ্চর্যের তেমনই অদ্ভুত৷ এমনকি এর এমন কিছু কিছু প্রয়োগের কথা আছে যেগুলো বিশ্বাস করা একটু কঠিন, মানে আয়ুর্বেদের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই নেই৷ প্রধান যে গুণ, সেটা তো ইয়ারসাগুম্বার সঙ্গে একেবারে হুবহু মিলে যায়ই৷ এ ছাড়াও এর দ্বারা বেশ কিছু জটিল স্নায়ুরোগের চিকিৎসা, বিভিন্ন মেয়েলি অসুখের প্রতিবিধানও নাকি সম্ভব৷
শুধু শেষের শ্লোকটার অর্থ তখন বুঝতে পারিনি৷ যখন বুঝতে পারলাম, তখন ব্যাপারটা হাতের বাইরে চলে গেছে৷’’
‘‘কী সেটা?’’ প্রশ্নটা কে করল ঠিক বোঝা গেল না৷
একটু থামলেন চাটুজ্জেমশাই, তারপর একটা সংস্কৃত শ্লোক আওড়ালেন, ‘‘‘গোলকপুষ্পাৎ মহাভয়ং সঞ্জাতং যদ্ভবিষ্যতে৷ তদ্ভয়ং নিবারণার্থং গোলকপুষ্পং বিধীয়তে৷’ অর্থাৎ গোলকপুষ্প থেকে যদি মহাভয় উৎপন্ন হয়, তাহলে গোলকপুষ্পেরই সাহায্য লইবে৷
তবে যেটা দেখে আমি উত্তেজিত হয়ে উঠলাম, সেটা হচ্ছে যে এই ভেষজটির প্রাপ্তিস্থান একেবারে নির্দিষ্ট করে লিখে দেওয়া হয়েছে৷ আর সেই শ্লোকটা এতবার পড়েছি যে মুখস্থ হয়ে গেছিল৷ বেংমোরা গ্রামস্য উত্তরম্ মাগুরি ইতি নামঃ সরঃ৷ তত্র দেবীস্থানে জাতি ইয়ম্ গুল্মম্ বিচিত্রম্ চ৷ অর্থাৎ কিনা, বেংমোরা গাঁওয়ের উত্তরে যে মাগুরি বিল, তার কাছে আছে দেবীস্থান৷ সেই মন্দিরের গর্ভগৃহেই ফোটে এই আশ্চর্য গুল্মলতাটি৷
বেংমোরা যে উত্তর আসামের প্রধানতম শহর তিনসুকিয়ার আদি নাম, সে আমি জানতামই৷ ম্যাপ দেখে-টেখে মাগুরি বিলও খুঁজে পাওয়া গেল৷ বলা বাহুল্য এরপর যদি এর খোঁজে তিনসুকিয়ার জঙ্গলে না যাই, তবে আমার আয়ুর্বেদশাস্ত্রে এতদিনের আগ্রহ সবই বৃথা৷ টাকার কথাটাও ভুললে চলবে না৷ একবার যদি খুঁজেপেতে এই জিনিস আমার হাতে আসে, আর তারপর যদি এর সাপ্লাইয়ের ব্যবসাটা দাঁড় করাতে পারি, তাহলে আমার অন্নবস্ত্রের সংস্থানের কথা ছেড়েই দিলাম, আমার পরের কয়েকপুরুষ পায়ের ওপর পা তুলে হেসে খেলে চালিয়ে দিতে পারবে৷ তার ওপর খ্যাতির লোভটাও কম নয়, চাই কি হয়তো ভেষজটার বৈজ্ঞানিক নামকরণই হয়ে গেল অফিওকর্ডিসেপ্স ভবতারণেসিয়া!