মাথা চুলকে বললাম, ‘‘আসলে খেয়াল হয়নি৷ এখন ওই মহালয়ার কথাটা বললেন বলে মনে পড়ল৷’’
কাকা দ্রুত পায়ে বাইরে বেরিয়ে এদিক-ওদিক দেখে চেঁচিয়ে একটা রিকশা ডাকলেন৷ আমাকে বললেন, ‘‘রিকশায় ওঠো৷ এক্ষুনি সদানন্দবাবুর বাড়ি যেতে হবে৷ মাধুরীর সঙ্গে আমার কথা বলা প্রয়োজন, খুব প্রয়োজন৷’’
* * * *
রাত বারোটা৷ আমার ঘরটার মাঝখানে একটা টেবিল এনে রাখা হয়েছে৷ তার চারদিকে চারটে চেয়ার৷ তিনটে চেয়ারের একটায় আমি, একটায় কাকা আর একটায় মাধুরী৷ অন্য চেয়ারটা ফাঁকা৷
ঘরের দরজা-জানলা সব বন্ধ৷ মাথার ওপর ফ্যানটা অফ করে দেওয়া হয়েছে৷ অফ করে দেওয়া হয়েছে টিউবলাইটও৷
ঘরের মধ্যে আলোর উৎস বলতে তিনটে মোটা মোমবাতি৷ মোমবাতিগুলো জ্বালিয়ে টেবিলের ওপরে রাখা৷ টেবিলের ওপর আরও কয়েকটা জিনিস রাখা৷ কয়েকটা ছোট বাটি, একটা তামার পাত্র, কয়েকটা শেকড়বাকড় ইত্যাদি৷
কাকার বেশবাস এখন অন্যরকম৷ পরনে একটি লাল রঙের ধূতি৷ খালি গা৷ মাথায় একটি ছোট গেরুয়া কাপড়ের টুকরো ফেট্টির মতো করে বেঁধেছেন৷ কপালের একটি লাল টিকা, মোমবাতির আলোয় চকচক করে জ্বলছে সেটি৷
কাকাকে যতই দেখছি ততই অচেনা লাগছে৷ আজ দুপুরে পরাগের ওখান থেকে ফিরে এসে মাধুরীর সঙ্গে বন্ধ ঘরে কীসব আলোচনা করলেন৷ তারপর উধাও হয়ে গেলেন কোথাও৷ বললেন যাচ্ছেন এক জায়গায়, উনি ফেরার আগে এ বাড়ির কেউ যেন এক পা-ও বাড়ির বাইরে না রাখে৷ উনি সন্ধে নাগাদ ফিরবেন৷ রাতে আমাকে আর মাধুরীকে ডিনার করতে বারণ করলেন৷
কাকা ফিরেছেন ঘণ্টাখানেক আগে৷ দেখলাম স্নান করে এসেছেন৷ আমাকে আর মাধুরীকেও স্নান করে নিতে বললেন৷ বললেন রাতে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে আমাদের দুজনের৷ সেটা ঠিকঠাকভাবে সম্পন্ন না হলে নাকি আমাদের সবার সমূহ বিপদ!
এই সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজ?
কাকা প্রথম কথা বললেন মাধুরীকে উদ্দেশ করে, ‘‘মাদুলিটা এনেছ?’’
মাধুরী মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল৷
‘‘মাদুলিটা খুলে ফেলা তোমার উচিত হয়নি মা৷’’
‘‘আসলে…আসলে দিভাই বললেন বলে…আমি তো বিয়ের পর মাদুলি পরেই গেছিলাম ও বাড়ি৷’’
‘‘তাহলে খুললে কেন?’’
‘‘কী করব বলুন? দিভাই বললেন যে!’’
‘‘কী বললেন দিভাই?’’ টেবিলের ওপর একটু ঝুঁকে এলেন কাকা, ‘‘কী করলেন? স্টেপ বাই স্টেপ বলে যাও৷’’
‘‘স্টেপ বাই স্টেপ?’’ প্রশ্নটা শুনে চোখ বন্ধ করে ভুরু কুঁচকে ভাবতে লাগল মাধুরী, ‘‘ও বাড়ি গিয়ে বরণ-টরণ সব হল৷ তারপর বাড়িতে ঢুকে দিভাইকে প্রণাম করলাম৷ দিভাই আমাকে তুলে জড়িয়ে ধরতে গিয়েই কেমন একটু পিছিয়ে গেলেন৷ কিছু বললেন না৷ তারপর আমি যখন ঘরে ঢুকে মুখ-হাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে অন্য একটা শাড়ি পরে বসেছি, এমন সময় দিভাই ঘরে এলেন৷ বাকি সবাইকে ঘর থেকে বার করে দিয়ে আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন৷ হাতের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘এটা কী পরেছিস রে ভাই?’
বললাম, ‘মাদুলি৷ আমার দিদুন মারা যাওয়ার আগে দিয়ে গেছিলেন৷’
দিভাই তখন কিছু বললেন না৷ শুধু লক্ষ করলাম যে তারপর থেকে আমাকে একটু এড়িয়ে এড়িয়ে চলছেন৷ রাতের বেলা শুতে যাব, দেখি দিভাই ঘরে এলেন৷ একটা-দুটো কথার পর বললেন, ‘তোকে একটা কথা বলি ভাই, সব ফ্যামিলির তো কিছু নিয়ম-টিয়ম থাকে৷ তা আমাদের বাড়ির নিয়ম হচ্ছে বাইরের কোনো মাদুলি তাগা তাবিজ এইসব না পরা, বুঝলি তো?’ আমি তো বুঝিনি, বললাম, ‘বাইরের বলতে?’ তখন দিভাই বললেন, ‘মানে এ বাড়িতে কারও কোনো মাদুলি, জলপড়া ইত্যাদির দরকার হলে আমিই ব্যবস্থা করে দিই৷ অন্য কারও বানানো মাদুলি-টাদুলি এই বাড়িতে ঢোকে না ভাই৷’ আমিও ভাবলাম, হবেও বা, কত বাড়িরই তো কত নিয়ম থাকে৷ তাই আমিও খুলে আমার ভ্যানিটি ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলাম৷’’
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কাকা, বললেন, ‘‘কর্ণ যদি কুরুক্ষেত্রে নামার আগেই তার কবচ-কুণ্ডল ফেলে আসে, তাহলে আর তাকে বাঁচায় কে? তা এখন মাদুলিটা সঙ্গে করে এনেছ তো?’’
‘‘হ্যাঁ এনেছি’’, বলে সঙ্গের বটুয়ায়াটা থেকে মাদুলিটা বার করে টেবিলের ওপরে রাখতে গেল মাধুরী৷ কাকা সঙ্গে সঙ্গে হাত তুলে আটকালেন, ‘‘এখন নয়, যখন বলব তখন৷’’
কাকা এবার সঙ্গের জিনিসগুলো নিয়ে কাজ শুরু করলেন৷
প্রথমে যে জিনিসটা হাতে তুলে নিলেন, সেটা আমি খুব ভালো চিনি৷ ওটা শ্বেতবেড়েলার মূল৷ তারপর নিলেন কয়েকটা নিমকাঠের ডাল আর আমার অজানা কোনো গুল্মলতা, ফুল সহ৷
তিনটি মোমবাতি একত্র করে তার আগুনের ওপর তিনটি একত্র করে ধরলেন৷ গোছাটা পুড়তে পুড়তেই একটা বাটি থেকে সামান্য চন্দনবাটা নিয়ে তার ওপর আঙুলের ছোঁয়ায় ছিটিয়ে দিলেন৷ সঙ্গে সঙ্গে একটা তীব্র মিষ্টি অথচ কড়া গন্ধে ঘরটা ভরে গেল৷
এবার গোছাটা আগুন থেকে সরিয়ে আনলেন কাকা৷ তারপর মাথার দিকটা একসঙ্গে বাঁধলেন৷ এবার তিনটে বাটিতে রাখা তরলগুলো তামার পাত্রে ঢালতে লাগলেন৷
‘‘এগুলো কী কাকা?’’
‘‘শ্বেতসর্ষের তেল, ধনে ফুলের মধু আর রক্তচন্দন৷’’
তিনটে তরল ওই আধপোড়া গোছা দিয়ে বেশ করে ঘেঁটে নিলেন কাকা৷ তারপর একটা ছোট বেলকাঁটা বার করে মাধুরীর হাতে দিয়ে বললেন, ‘‘তিন ফোঁটা রক্ত লাগবে মা৷’’
ভেবেছিলাম মাধুরী ইতস্তত করবে৷ তার বদলে বেশ স্মার্টলি কাঁটাটা নিয়ে আঙুলে ফোটাতে উদ্যত হল৷