‘‘তুমি না আয়ুর্বেদের ছাত্র?’’ মৃদু ধমক দিলেন কাকা, ‘‘গাছগাছড়া নিয়ে এত কম জ্ঞান নিয়ে আয়ুর্বেদচর্চা করো কী করে? নেপেনথিস, মানে পিচার প্ল্যান্টের নাম শোননি? ভেনাস ফ্লাই ট্র্যানপ? রাউন্ডলিফ সানডিউ? গাছ পোকামাকড় খেতে পারে, আর রক্ত খেতে পারে না?’’
দমে গেলাম৷ তাহলে তো সত্যিই সে লতা তুলে নিয়ে যাওয়ার উপায় নেই!
আড়চোখে আমার দিকে তাকালেন কাকা, তারপর বললেন, ‘‘ভেঙে পড়ার কিছু হয়নি ভাইপো৷ তুমি স্বচ্ছন্দে ও লতা তুলে অন্য কোথাও নিয়ে গিয়ে চাষ করতে পারবে৷ ওর কোনো অসাধারণ ভেষজ গুণ থাকতে পারে বটে, কিন্তু ও নিরামিষাশী লতা৷ ওই বলির রক্তের গল্পটা ভাঁওতা৷’’
‘‘কী করে বুঝলেন যে বলির রক্তের গল্পটা ভাঁওতা?’’ সোজা হয়ে বসলাম চেয়ারে৷
আমার দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন কাকা, ‘‘শুধু শুনে গেলে হবে ভাইপো, যেটা শুনলে সেটা তলিয়ে ভাববে না? এতক্ষণ অবধি যা যা শুনেছ, তার মধ্যেই তোমার প্রশ্নের লুকিয়ে আছে৷ একটু যুক্তি দিয়ে ভাবো দেখি৷’’
বলা বাহুল্য, অনেক ভেবেও কোনো কূলকিনারা করতে পারলাম না৷ কাকার কাছে আত্মসমর্পণ করতেই হল৷
‘‘মগলহানজামা যখন তাঁর মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যান, তার কত বছর পর ফিরে এসেছিলেন?’’
‘‘বেশ কয়েক বছর পর৷ তখন সঙ্গে তাঁর মেয়ে, দুই ছেলে আর দ্বিতীয় স্ত্রী৷’’
‘‘নিশ্চয়ই সেই বেশ কয়েক বছরের পরেই মগলহানজামা ওরফে আটন বসুমাতারি তাঁর মেয়েকে কাউরীবুড়ির মন্দিরে নিয়ে যান পুজো চালু করতে, তাই না?’’
‘‘নিশ্চয়ই তাই৷’’
‘‘তাই যদি হয়, তাহলে ওই বেশ কয়েক বছর ওই পরিত্যক্ত মন্দিরে কে যেত কাউরীবুড়ির সামনে বলি দিতে? সেই ক’বছর কে বলির রক্ত গোলকপুষ্পের গোড়ায় ঢালত? অত বছর বলির রক্ত ছাড়া ও লতা বাঁচল কী করে?’’
হাত এঁটো না থাকলে তক্ষুনি কাকার পায়ের কাছে উপুড় হয়ে পড়তাম তাতে সন্দেহ নেই৷ সাধে লোকটার ফ্যান আমি?
অর্থাৎ আমার আগের প্ল্যান বলবৎ রইল৷ এইখান থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে একবার কালিম্পং পৌঁছোনোর ওয়াস্তা, ব্যস! জয়ত্তারা, জয় কালিকে শ্মশানবাসিনী!
কাকা খেতে খেতে অন্যমনস্কভাবে বললেন, ‘‘অলৌকিক ওখানে নেই হে৷ অলৌকিক কিছু রয়েছে তোমার সদানন্দকাকার বাড়িতে, বুঝলে৷ খুব খারাপ কিছু একটা ঘটছে ওখানে, খুব খারাপ৷ মুশকিল হচ্ছে কাউরীবুড়ির ছায়া ওই বাড়িতে ঢুকল কেন বা কী করে, সেটা আমার মাথায় এখনও ঢুকছে না৷’’
‘‘আপনিই তো বললেন আমি ওখানে গেছিলাম বলে…’’
‘‘উঁহুঁ, প্রথমে তাই ভেবেছিলাম বটে, কিন্তু এখন ভেবে দেখছি তা নয়৷ তাহলে তোমার যা ক্ষতি হওয়ার সেদিনই হয়ে যেত৷’’
‘‘কিন্তু তাহলে…’’
‘‘তাহলে দুটোর মধ্যে কিছু একটা যোগ তো আছেই৷ কিন্তু সেই যোগটা যে কী সেটা বলতে পারছি না৷ তবে আমার গণনা বলছে আগামীকাল দুপুরের মধ্যে তার একটা সুরাহা না হলে তোমার, মাধুরীর, এমনকি সদানন্দবাবু ও তাঁর স্ত্রীর ওপরে মারাত্মক কিছু একটা হতে পারে৷’’
আমি প্রথম দিন মাধুরীর হাত দেখে কী জানতে পেরেছিলাম সেটা বললাম কাকুকে৷ বৈধব্য যোগের কথাটাও জানালাম৷
‘‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, অনির্বাণও হতে পারে৷’’ অন্যমনস্কভাবে বললেন কাকা, ‘‘মোটমাট ও বাড়ির কারও একজনের গভীর প্রাণসংশয় আছে ভবতারণ৷ এবং সেটা বোধহয় আটকানো যাবে না৷’’
বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল৷ মনে পড়ল সকালে কাকুর বাড়ির উঠোনে আমার কবন্ধ ছায়াটার কথা৷
‘‘উপায় কী কাকু?’’ ধরা গলায় জিজ্ঞেস করলাম৷ সকালের সেই ভয়ের অনুভূতিটা আবার আমার বুকের মধ্যে ফিরে আসছিল৷
‘‘মাধুরীর স্বপ্নের সেই বৃদ্ধা মহিলা কে, সেটা যদি একবার জানা যেত’’, দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কাকা, ‘‘তাহলে হয়তো একটা চেষ্টা করলেও করা যেতে পারত৷ মুশকিল হচ্ছে যে টাইম কমে আসছে, কাল রাত্রের মধ্যেই যা করার করে ফেলতে হবে৷ এর মধ্যে কী করে…’’
‘‘কেন? কাল রাত্রের মধ্যে কেন?’’
‘‘কাল মহালয়া বলে৷’’ হোটেলের বাইরে এসে মৌরি মুখে ফেলে বললেন কাকু, ‘‘পরাগ তোমাকে মহালয়ার দিনটার কথাই বলল কেন, সেটা ভেবেছ কখনও?’’
‘‘কেন কাকা?’’
‘‘কাল মহালয়া৷ পিতৃপুরুষদের উদ্দেশে তর্পণের দিন৷ যাঁরা একদিন অনেক রক্ত ঘাম কষ্টের বিনিময়ে আমাদের এই পৃথিবীর আলো দেখিয়েছিলেন, আমাদের বেঁচে থাকার একটা ন্যূনতম ব্যবস্থা করে দিয়ে গেছিলেন, তাঁদের প্রতি ধন্যবাদ জানাবার দিন৷ কাল তাঁরা তাঁদের বাসস্থান ছেড়ে নেমে আসবেন পৃথিবীর সবচেয়ে কাছাকাছি, দেখে যাবেন তাঁদের রক্তের উত্তরাধিকারীরা কে কোথায় আছে, কেমন আছে৷ এই দিনেই যে পরাগ বসুমাতারি তার পূর্বপুরুষের বাসভূমিতে ফিরে যেতে চাইবে, তাতে আর সন্দেহ কী?’’
কথাটা শুনে একটা কথা মাথায় স্ট্রাইক করে গেল, ‘‘কাকা, আপনার এই মহালয়া আর পূর্বপুরুষদের কথা শুনে একটা কথা মনে পড়ে গেল৷ সেদিন খাওয়ার টেবিলে মাধুরী একটা বেশ ইন্টারেস্টিং গল্প বলেছিল বটে৷’’
‘‘কী সেটা?’’
কাকাকে মাধুরীর দিদিমার কথাটা বিশদে বললাম৷ দিদিমার সাধন-ভজন, মাধুরীকে বলে যাওয়া যে ও ঈশ্বরকোটির মেয়ে, ওর মধ্যে ভৈরবীচিহ্ন আছে, ওর নামে করা বিশেষ যজ্ঞ, সেই যজ্ঞ থেকে পাওয়া মাদুলি, সব কথাই খুলে বললাম৷
আমার কাঁধটা খামচে ধরলেন কাকা, ‘‘এসব কথা আমাকে আগে বলোনি কেন?’’