‘‘সেই রাতে পাতরগোঁয়্যাদের গ্রামে যা ঘটেছিল সেটা দেখেছিলেন মাত্র তিনজন৷ কারণ বাকিরা অচৈতন্য হয়ে ছিল, তারা কিছু দেখার কোনো সুযোগই পায়নি৷ তিনজনের মধ্যে একজন চাংদেওমাই নিজে৷ তিনি এ কথা কাউকে বলার সুযোগ পাননি, কারণ সেই রাতেই তিনি আত্মহত্যা করেন৷ দ্বিতীয়, তাঁর কন্যাসন্তান৷ কিন্তু তখন তার বয়েস মাত্র এক, তার সেসব মনে থাকার কথা নয়৷ আর পড়ে থাকেন একজন৷ যিনি পুরো ঘটনাটা সামনে থেকে দেখেছেন৷ স্ত্রীর দৌলতে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন৷ পরের দিন সময়-সুযোগ মতো এসে নিজের মেয়েকে নিয়েও গেছেন স্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী৷
এবার বলুন তো দাদামশাই, যে ঘটনার এই পৃথিবীতে একজন মাত্র প্রত্যক্ষদর্শী, সেই ঘটনা আপনার বাপ-দাদারা জানলেন কী করে?’’
বুলস আই হিট! পলকে বুড়োর সারা মুখ রাঙা৷ পরাগ একদম শক্ত হয়ে আছে৷ আমারও মনে হচ্ছে যেন বুকের মধ্যে একটা ইঞ্জিন দৌড়োচ্ছে৷
শোনা যায় না এমন একটা দুর্বল স্বর ভেসে এল বুড়োর কাছ থেকে, ‘‘চাংদেওমাইয়ের স্বামীর নাম ছিল মগলহানজামা৷ সেই অভিশপ্ত রাতের পরের দিন সন্ধেবেলায় মগলহানজামা লুকিয়ে লুকিয়ে ফেরত আসেন তাঁর গ্রামে৷ তারপর মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যান অরুণাচল প্রদেশের দিকে৷’’
বলে আরেকটু থামে বুড়ো, তারপর ধীর স্বরে বলে, ‘‘ওখানে গিয়ে তিনি আরেকটি বিয়ে করেন৷ অনেকদিন পরে মগলহানজামা তাঁর প্রথম কন্যা, দ্বিতীয় স্ত্রী এবং আরও দুটি পুত্রসন্তান নিয়ে ফিরে আসেন এখানে, আর দিবংগোঁয়্যাদের সমাজে মিশে যান৷ এখানে এসে একটা নতুন নাম নেন তিনি৷ আটন৷ আটন বসুমাতারি৷’’
* * * *
পরাগের বাড়ি থেকে ফিরতে ফিরতে বেশ বেলা হয়ে গেল৷ আমরা ফোনে কাকিমাকে বলে দিলাম যে লাঞ্চটা বাইরেই সারব৷
পরাগ কেন ওখানে ফিরে যেতে চায় সেটা আমাদের কাছে এখনও খুব একটা স্পষ্ট নয়৷ পরাগের বক্তব্য, যেহেতু ওরা আসলে পাতরগোঁয়্যাদের উত্তরাধিকারী, তাই সে তার পূর্বপুরুষের বাসভূমিটা একবার দেখে আসতে চায়৷ বলা বাহুল্য, এ যুক্তিটা আমাদের খুব একটা মনে ধরেনি৷ তবে কাকা ওর কাছ থেকে কথা আদায় করে নিয়েছেন যে ও আমাদের সবরকম সাহায্য করবে৷ ওকে বলেছি গোলকপুষ্পের লতা তুলে দিতে আমাকে সাহায্য করলেই যথেষ্ট৷ বাকি ওর পিতৃপুরুষের ভিটে নিয়ে ও যা খুশি করুক৷
‘‘একটা কথা বলুন কাকা, সেদিন যে ভদ্রমহিলাকে দেখেছিলাম কাউরীবুড়ির মন্দিরে, তিনি যদি চাংদেওমাইয়ের উত্তরসূরি হন, তাহলে তো তিনি লতায় পাতায় এই পরাগেরই আত্মীয় হবেন, তাই নয় কি? তাহলে তো পরাগের জানার কথা তিনি কে, কী বলেন আপনি?’’ একটা রাস্তার হোটেলে বসে ডাল দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে প্রশ্নটা করলাম৷
‘‘মনে হয় না৷ সেক্ষেত্রে পরাগ এতদিন অপেক্ষা করে থাকত না৷ আর একটা কথা ভেবে দ্যাখো, মগলহানজামা আর পরাগের মধ্যে আড়াইশো বছরের ব্যবধান৷ তার মধ্যে মন্বন্তর এসেছে, দু-দুখানা বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ, দাঙ্গা, এর মধ্যে ফ্যামিলির কে কোথায় ছিটকে যায় কেউ তার খেয়াল রেখেছে? রাখা সম্ভব?’’
‘‘তার মানে আপনার মতে ওদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ নেই, মগলহানজামার দুই স্ত্রীর সন্তানের পরিবার একদম আলাদা হয়ে গেছে, কারেক্ট? তার মধ্যে পরাগের পরিবার জানে যে ওরা পাতরগোঁয়্যাদের একমাত্র উত্তরসূরি৷ আর চাংদেওমাইয়ের সেই মেয়েটির উত্তরসূরিরা কাউরীবুড়ির মন্দিরে পুজোর ট্র্যাডিশনটাকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে৷ ঠিক বলেছি তো?’’
‘‘একদম ঠিক বলেছ৷ এ ছাড়া অন্য কিছু হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই৷’’
‘‘আচ্ছা, চাংদেওমাই যখন মারা যান, তখন তাঁর মেয়ের বয়েস এক৷ তিনি নিশ্চয়ই তাঁর জাদুবিদ্যার কিছুই তাঁর মেয়েকে শিখিয়ে দিয়ে যেতে পারেননি৷ তাহলে ওই মন্দিরে যে ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমার দেখা হল, তাঁর মধ্যেও কি বড়দেওরি হওয়ার জন্য কিছু অলৌকিক শক্তি-টক্তি থাকা সম্ভব?’’
খেতে খেতে থেমে গেলেন কাকা, বললেন, ‘‘বলা মুশকিল ভাইপো৷ ইন ফ্যাক্ট এই প্রশ্নটাই তো আমাকে সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে হে৷ ধরো এমনটাও তো হতে পারে, চাংদেওমাই তাঁর বেশ কিছু গুপ্তবিদ্যা তাঁর ভালোবাসার মানুষ মগলহানজামাকে শিখিয়ে দিয়ে গেছিলেন৷ মগলহানজামা আবার তাঁর প্রথম সন্তানকে সেই গুপ্তবিদ্যার উত্তরাধিকার দান করে দিয়ে যান৷ সেই থেকে চাংদেওমাইয়ের মেয়েরা বংশানুক্রমে পাতরগোঁয়্যাদের বড়দেওরির গুপ্তজ্ঞানের অধিকারী৷ ইনফ্যাক্ট আমার মনে হয় সেটাই ঘটেছিল৷ নইলে অন্য কারও পক্ষে এতদিন ধরে ওই গোলকপুষ্পের লতা বা ফুলের পরিচর্যা করে যাওয়া সম্ভব নয়৷’’
‘‘আপনি কী সত্যিই বিশ্বাস করেন যে ওই লতাটার মধ্যে অলৌকিক শক্তি আছে?’’
‘‘না৷’’ কাকার সংক্ষিপ্ত জবাব৷
‘‘কিন্তু তাহলে কি ওই পুথিটা ফেক? গোলকপুষ্পের ফুলের গল্পটা ভুল?’’
‘‘তা তো বলিনি ভাইপো৷ গোলকপুষ্পের লতার বা ফুলের একদম অজানা কোনো আয়ুর্বেদিক গুণ থাকতেই পারে৷ সেটা অলৌকিক হতে যাবে কেন? তাহলে তো কুইনাইন, পেনিসিলিন এসবকেও অলৌকিক বলে ধরতে হয়৷’’
‘‘কিন্তু সেই ভদ্রমহিলা যে বললেন কাউরীবুড়ির কাছে বলি দেওয়া পশু বা পাখির রক্ত ছাড়া ও লতা বাঁচে না! আপনি আজ অবধি শুনেছেন এমন কোনো লতা যা রক্ত খেয়ে বাঁচে?’’