‘‘আর মাধুরী? তার কী হবে কাকা?’’ ঠকঠকানিটা আটকাতে দাঁতে দাঁত চেপে বললাম কথাটা৷
‘‘ও আর বেঁচে নেই ভবতারণ’’, ধীর অথচ শান্ত সুরে বলা কথাটা আমার মগজে সেঁধোতে একটু সময় নিল, ‘‘ওর ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়ে গেছে৷ ওর আয়ু আর মাত্র দু’দিন৷’’
* * * *
গতকাল ওই সকালেই আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন কাকা৷ প্রথম গন্তব্য ছিল পরাগ বসুমাতারির বাড়ি৷ প্রথম দিনই পরাগের অফিসের ফোন নাম্বার চেয়ে নিয়েছিলাম আমি, তাই তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বেশি কষ্ট করতে হয়নি৷
‘‘কিন্তু কাকা’’, রিকশা করে যেতে যেতে একটা বাম্পারে ঝাঁকুনি খাওয়ার মুখেই প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করে ফেললাম, ‘‘আবার ওর বাড়ি গিয়ে কী হবে? যা জানবার সেসব তো আমি জেনেই এসেছি৷’’
কাকা কোনো জবাব দিলেন না৷ মুখটা অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে আছে৷ আমি আবার খোঁচালাম, ‘‘আপনার কী মনে হয়, আরও কিছু জানার আছে ওদের থেকে?’’
রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিতে দিতে গম্ভীর গলায় উত্তর দিলেন কাকা, ‘‘অনেক কিছু জানার আছে ভাইপো, অনেক কিছু৷ তুমি কিছুই জানোনি৷’’
‘‘কেন?’’ একটু প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলাম আমি, ‘‘যা যা জেনেছি তা সবই তো বলেছি আপনাকে, বলিনি?’’ পরাগের বাড়ি যাওয়ার পথে হাঁটতে হাঁটতে বললাম আমি৷
‘‘তাই?’’ হাঁটা থামিয়ে আমার দিকে তাকালেন ভদ্রলোক, ‘‘সব জানিয়েছ?’’
‘‘হ্যাঁ৷’’
‘‘সব জেনেছ?’’
‘‘হ্যাঁ৷’’
আমার দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে মাথা নাড়া শুরু করলেন ভদ্রলোক৷ ‘‘ভুল ভাইপো, ভুল৷ তুমি যা যা জেনেছ তার সবই আমাকে বলেছ বটে, কিন্তু যেগুলো জানা উচিত ছিল সেগুলোই জানোনি৷ অথবা জানার চেষ্টা করোনি৷ অথচ এই রহস্য ভেদ করতে গেলে…’’
বেশ দৃঢ় আপত্তি জানালাম এই কথায়, ‘‘আপনি ঠিক বলছেন না কাকা৷ যে যে তথ্য দরকার তার সবই তো বলেছি আপনাকে৷’’
‘‘বটে?’’ মৃদু হাসলেন কাকা, ‘‘তাহলে বলো তো ভায়া, অনির্বাণের সঙ্গে কথা বলেছিলে?’’
‘‘সে কী করে বলব?’’ আমি আপত্তির সুরে বললাম, ‘‘তাকে তো কাকু-কাকিমা খুঁজেই পাচ্ছেন না৷’’
‘‘খুঁজেই পাচ্ছেন না মানে? অত বড় একটা চা-বাগানের একজন দায়িত্বশীল কর্মীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না? যেখানে সদানন্দবাবু নিজে একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী? কথাটা বিশ্বাস হল তোমার?’’
মাথা চুলকোতে লাগলাম৷ সত্যিই তো, এভাবে তো ভেবে দেখিনি৷
‘‘তুমি নিজে খোঁজ করার চেষ্টা করেছিলে?’’
মাথা নাড়লাম, ‘‘না…মানে সময় পেলাম কই?’’
‘‘ছেলেটাকে না পেলে যে এই রহস্যের একটা বড় দিক অন্ধকারে থেকে যাচ্ছে সেটা বুঝছ?’’
বুঝলাম৷ এরপর মাথা নীচু করে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না৷ তবে কাকা ছাড়বার লোক নন৷ তাঁর পরের প্রশ্নবাণ ধেয়ে এল, ‘‘কাউরীবুড়ির মন্দিরে যে মহিলার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল তাঁর নাম কী?’’
‘‘ইয়ে, মানে নামটা তো জিজ্ঞেস করা…’’
‘‘কে তিনি? নিশ্চয়ই লোকাল লোক, নইলে অনেক দূর থেকে উজিয়ে কেউ পুজো করতে আসে না৷’’
‘‘সে আমি কী করে জানব?’’
‘‘জানার চেষ্টা করেছিলে?’’
এবার ঘোরতর প্রতিবাদ করে উঠলাম, ‘‘এ তো বড় অসম্ভব কথা বললেন কাকা৷ এত বড় শহরে কোথায় খুঁজব ওই মহিলাকে?’’
‘‘এত বড় শহর?’’ কাকার গলায় বিদ্রুপের ছাপ স্পষ্ট, ‘‘কত বড় টাউন তিনসুকিয়া? কলকাতার থেকেও বড়? শিলিগুড়ির থেকেও বড়?’’
চুপ করে রইলাম৷
‘‘মাধুরীকে কোন মূর্তি দিয়েছিলেন ওর দিভাই? তার বর্ণনা জানার চেষ্টা করেছ?’’
মাথা নাড়লাম৷ না৷
‘‘সিঁদুর পরার সময় কার সতর্কবাণী শুনত মাধুরী? সে স্বর কি ওর চেনা কারও?’’
এর উত্তরও জানি না৷ তবে চেনা কারও হলে কি মাধুরী আমাকে সেটা জানাত না?
‘‘পরাগ কেন রাজি হয়ে গেল ওই লতা তুলে আনতে? শুধুই টাকার লোভ?’’
‘‘সে তো বটেই৷ এ ছাড়া আর কী কারণ থাকতে পারে বলুন?’’
‘‘একজন দেওরি আদিবাসী, খুব সম্ভবত প্রথম প্রজন্মের শিক্ষিত, সে নাকি শিক্ষাদীক্ষা পেয়ে এতটাই সংস্কারবিহীন হয়ে উঠেছে যে অমন ভয়ংকর মন্দিরে তোমার সঙ্গে এক্সপিডিশনে যেতে রাজি হয়ে গেল? ওর বড় ঠাকুর্দা কিছু বললেন না বা বারণ করলেন না? তিনিও হঠাৎ প্রচণ্ড সংস্কারমুক্ত নাস্তিক হয়ে পড়লেন নাকি?’’
চুপ করে রইলাম৷
‘‘আমি বাজি ধরতে পারি ভাইপো, ওই দাদু-নাতি মিলে একটা মস্ত কিছু চেপে যাচ্ছে তোমার কাছে৷ আমি জানি না সেটা কী, তবে আন্দাজ করতে পারি৷’’
‘‘সেটা কী কাকা?’’ গলাটা শুকনো শুকনো লাগছিল আমার৷
‘‘ওই বুড়ো জানে পাতরগোঁয়্যাদের গ্রামে কী হয়েছিল৷ ও জানে যে কাউরীবুড়ি কী অভিশাপ দিয়েছিলেন৷ ও জানে কীসের অভিশাপে ছারখার হয়ে গেছিল সেই জনজাতি৷ সেটা ও চেপে যাচ্ছে ভবতারণ৷ আমি এ বিষয়ে একদম নিঃসন্দেহ৷’’
‘‘কিন্তু আমাকে এসব লুকিয়ে ওদের লাভ?’’ কাতর কণ্ঠে বললাম৷
‘‘সে লাভ-লোকসানের গল্প তো ওই বুড়ো বলবে ভাইপো৷ আর বলবে ওর নাতি, শ্রীমান পরাগ বসুমাতারি৷’’
‘‘কিন্তু সেসব জেনে আমাদের বিশাল কিছু লাভ হবে কি কাকা?’’
কাকা ঘুরে দাঁড়িয়ে দু’হাতে আমার কাঁধদুটো খামচে ধরলেন, ‘‘লাভ মানে? এই পুরো রহস্যে এই দুটো মাত্র সূত্রই তো আমার কাছে অধরা আছে ভাইপো৷ বাকি তো সব দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার৷’’
ভদ্রলোক যে কী বলছেন সেসব আমার মাথায় ঢুকছিল না৷ বাকি সবই দিনের আলোর মতো পরিষ্কার মানে? গত তিনদিন ধরে যে রহস্য নিয়ে আমি থই খুঁজে পাচ্ছি না, উনি স্রেফ একদিনের মধ্যেই প্রায় তার সমাধান করে ফেললেন? তাও দুটো মাত্র সূত্র বাদ দিয়ে?