তাড়াহুড়ো করে একটা টিশার্ট গলিয়ে বৈঠকখানায় এসে পৌঁছে দেখি যা ভেবেছি ঠিক তাই৷ ঘরের মধ্যে সদানন্দকাকু আর কাকিমা হাজির, এক কোণে মাধুরীও বসে আছে জড়োসড়ো হয়ে৷ আর প্রধান চেয়ারটাই দখল করে আছেন আর কেউ না, স্বয়ং কাকা!
বললে বিশ্বাস হবে না, লোকটাকে দেখামাত্র কোথা থেকে যেন বুকের ভেতর থেকে একটা পাথর নেমে গিয়ে সেই জায়গায় বেশ খানিকটা জোর, বেশ খানিকটা সাহস চলে এল৷ মনে হল এই লোকটা একবার যখন এসে গেছে তখন আর ভয় নেই৷
এখানে বলে রাখা ভালো, কাকার পুরো অ্যাপিয়ারেন্সের মধ্যেই একটা ভরসা দেওয়ার মতো ব্যাপার ছিল৷ ঠান্ডা মাথার লোক, কোনো কিছু আগ বাড়িয়ে বলেন না বা বোঝেন না৷ কোনো মতামত শোনা মাত্রই নস্যাৎ করেন না বা অন্ধের মতো বিশ্বাসও করেন না৷ কাউকে ছোট করেন না, কাউকে অযথা পাত্তা দেন না৷ শুধু ঠোঁটের ডগায় একটা স্মিত ঝুলিয়ে রেখে সমস্যাগুলো শোনেন আর আশ্চর্য বুদ্ধিমত্তায় সেগুলোর সমাধান করেন৷
‘‘কাকা, কখন এলেন?’’ হাঁপাতে হাঁপাতে প্রশ্ন করলাম৷
‘‘এই তো ভোরের ফ্লাইটে৷’’ উজ্জ্বল চোখদুটো আমার দিকে মেলে হাসিমুখে জবাব দিলেন কাকা৷ একটু লজ্জিত হলাম, এই অপশনটার কথা মাথাতেই আসেনি! আবার একটু অবাকও লাগল, ফ্লাইটে এসেছেন মানে সে তো কম খরচার ব্যাপার না৷ আমার কথা ভেবে এতটা খরচ করলেন উনি? মনে মনে ভাবলাম, এই সমস্যার সমাধান করে যেদিন শিলিগুড়িতে পা দেব সেইদিনই এই টাকাটা মিটিয়ে দেব ওঁকে৷
হায়, যদি জানতাম, সে সুযোগ আর কখনই পাব না!
কাকিমাকে দেখলাম প্রায় গলবস্ত্র হয়ে বসে আছেন, যেন কোনো গুরুঠাকুর এসেছেন৷ অথচ আমি কিন্তু এখনও এঁদের কাকার ব্যাপারে বিশদে কিছু বলিইনি৷ তবে কাকার শান্ত সমাহিত ভাব দেখে অনেকেই ওঁকে সাধু-সন্ন্যাসী গোছের ভাবেন৷ লোকেরও অবশ্য দোষ নেই৷ মাঝে মাঝেই আশেপাশের লোকজনকে এমন এমন কথা বলে চমকে দেন, লোকে তার থই পায় না৷ অথচ কাকাকে গেরুয়া দূরে থাক, হাফহাতা শার্ট আর ঢোলা ট্রাউজার ছাড়া অন্য কিছু পরতে দেখিনি৷ তবুও লোকটার মধ্যে একটা ভূয়োদর্শী সাধক সন্ন্যাসী গোছের ভাব বড়ই প্রবল ছিল৷
গিয়ে বুঝলাম যে একটা অনুরোধ-উপরোধের মধ্যে এসে পড়েছি৷ কাকিমা অনুরোধ করছেন এ বাড়িতেই থেকে যেতে৷ অনুরোধটা অসংগত নয়, এ বাড়িতে আরও একটা গেস্ট রুম আছে৷ কিন্তু কাকা দেখলাম স্মিতহাস্যে ক্রমাগত ঘাড় নেড়ে সে অনুরোধ উপেক্ষা করে চলেছেন৷ শেষমেশ কাকিমা হতাশ হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘বাবা, তুমিই ওনাকে বলো না এখানে থেকে যেতে?’’
আমি কিছু বলার আগেই কাকা আমার দিকে তাকিয়ে শান্ত অথচ দৃঢ়স্বরে বললেন, ‘‘না ভবতারণ, আমার পক্ষে এখানে থাকায় কিছু অসুবিধা আছে৷ এখানে থাকব না বটে, তবে আমি যখন তোমার কথা শুনে এসেছি, এঁদের সব সমস্যার সমাধান করে দিয়ে যাব৷ কিন্তু তোমারও এখানে আর এক মুহূর্ত থাকা উচিত নয়৷ আমি বলছি, আধঘণ্টার মধ্যে নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও৷ আমরা সার্কিট হাউসে গিয়ে থাকব৷’’
একটু আশ্চর্য হলাম৷ কাকা এমনিতে খুবই মৃদুভাষী লোক৷ এমন আদেশ দেওয়ার ভঙ্গিতে আজ অবধি আমার সঙ্গে কোনোদিন কথা বলেননি৷ কেন জানি আমার ভেতরে কে যেন বলল এই আদেশ আমার মান্য করা উচিত, তাতে আমার ভালোই হবে৷
পরক্ষণেই চোখ পড়ল মাধুরীর দিকে৷ জানি না সেই দৃষ্টিতে কী ছিল, আকুতি নাকি অনুরোধ, আমার বুকের ভেতর যেন কী একটা সজোরে বিঁধে গেল৷ আমি শান্ত স্বরে কাকাকে বললাম, ‘‘না কাকা, এই মুহূর্তে এই বাড়ি ছেড়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়৷ এঁরা আমার ওপর অনেক ভরসা করে আছেন৷’’
কাকা একবার আমার দিকে, একবার মাধুরীর দিকে তাকালেন৷ চোয়াল দুটো সামান্য শক্ত হয়ে এল ওঁর৷ চোখ বুজলেন একবার, বিড়বিড় করে কী যেন উচ্চারণ করলেন৷ তারপর চোখ খুলে বললেন, ‘‘ঠিক আছে, তাহলে তাই হোক৷ কিন্তু তোমাকে এই বাড়িতে রেখে যাওয়ার আগে তোমার জন্য একটি ক্রিয়া করতে হবে যে আমাকে৷’’
‘‘ক্রিয়া? কীসের ক্রিয়া?’’
কাকা কিছু বললেন না৷ একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ৷ তারপর হঠাৎ উঠে আমার হাত ধরে টেনে বললেন, ‘‘চলো, একটা জিনিস দেখাই তোমাকে৷’’
বলে আমাকে টেনে এনে বাইরে রোদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে দিলেন৷ তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘দেখলে?’’
চারিদিকে তাকালাম৷ কই, বিশেষভাবে লক্ষ করার মতো তো কিছু নজরে পড়ল না!
‘‘ওখানে নয়, নীচে৷ নিজের ছায়ার দিকে তাকাও৷’’
তাকালাম৷ আমার মাথার পেছনে সকাল এগারোটার সূর্য৷ পায়ের কাছে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে আমার ছায়া৷ তার সব কিছুই ঠিকঠাক, শুধু মাথাটা নেই৷
সেই কবন্ধ ছায়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর আমার ভীষণ শীত করতে লাগল৷ কাকার দিকে তাকিয়ে কাতর সুরে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‘এর মানে কী কাকা?’’
কাকা ফিসফিস করে বললেন, ‘‘কাউরীবুড়ির ছায়া পড়েছে তোমার ওপর ভাইপো৷ এ বড় ভয়ংকর ছায়া৷ এ বাড়িতে কাউরীবুড়ির ছায়া ঢুকেছে৷ থেকে থেকে কোনো বিধবা মহিলাকে দেখতে পাও না?’’
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম৷ অন্তত দু-দুবার কাকে যেন দেখেছি ওই কুয়োতলার পাশে৷
‘‘কাউরীবুড়ির ডাক তোমার পিছনে ফিরছে ভবতারণ৷ যেদিন তুমি ওই মন্দিরে গেছিলে, সেদিন থেকেই এ ছায়া তোমার পিছু নিয়েছে৷ তোমার নিস্তার নেই তার হাত থেকে৷ সেই রোষে তুমিও মরবে, এদেরও মারবে৷’’