‘‘লোকটা নিজেকে আমার ভেতরে সজোরে ঢোকাতে যাবে, আমার সমস্ত স্নায়ু রাগে ঘেন্নায় আর আতঙ্কে যেন ফেটে যাওয়ার মুখে, ঠিক সেই সময়ই কোথা থেকে যেন ঘরের মধ্যে একটা আলোর রেখা এসে পড়ল৷ লোকটা থেমে গেল একটু, আর কে যেন সশব্দে লাথি মেরে আমার ঘরের দরজাটা খুলে দিল৷ একঝলক দামাল দমকা হাওয়া ঢুকে পড়ল ঘরের ভেতর৷ সেই হাওয়া আর আলোর ঢেউতে চঞ্চল হয়ে উঠল লোকটা৷
যতটা সম্ভব ঘাড় বেঁকিয়ে দরজার দিকে তাকালাম আমি৷ অতি কষ্টে মাথাটা তুলে দেখলাম দরজার সামনে এক মহিলার সিল্যুয়েট৷ সম্ভবত বৃদ্ধা, কারণ সামান্য সামনের দিকে ঝুঁকে আছেন তিনি, হাতে একটা লাঠি৷ মাথার চুল উড়ছে শনের মতো৷ ঘরের মধ্যে একটু এগিয়ে এসে খুব ক্রুদ্ধ গলায় কী যেন একটা বললেন লোকটার উদ্দেশে৷ ভাষাটা অজানা৷ লোকটা সেই শুনে একবার পেছনে ফিরে তাকাল৷ তারপর তড়িঘড়ি উঠে এগোল জানালার দিকে৷ তারপর জানলা খুলে ঝাঁপ মারল বাইরে৷’’
‘‘তারপর?’’
‘‘তারপর আর কিছু মনে নেই দাদা৷ আমার হুঁশ ছিল না৷’’
উঠে গিয়ে জানলাটা খুলে দিলাম৷ পাখাটা বন্ধ ছিল, এক পয়েন্টে চালিয়ে দিলাম৷
ঘরের মধ্যে কোনো শব্দ নেই৷ আমার ঘরে একটা দেওয়ালঘড়ি আছে৷ সেটার দিকে তাকাচ্ছি ঘন ঘন৷ শিলিগুড়ি থেকে বিকেলের বাস বা ট্রেন তিনসুকিয়া আসতে কত সময় নেয় যেন?
‘‘তারপর জানি না কতক্ষণ পর কোনোমতে উঠে বসলাম খাটের ওপর৷ প্রথমে ভেবেছিলাম দুঃস্বপ্ন দেখছি বুঝি৷ তারপর নিজের হাল দেখে বুঝলাম, না, ওটা দুঃস্বপ্ন ছিল না৷
কোনোমতে নিজেকে গুছিয়ে উঠে বসলাম৷ তখনও অনি আসেনি ঘরে৷ ওকে যে ডাকব, সেই জোরটুকুও গলায় ছিল না আমার৷ পাশে একটা জলের জগ ছিল৷ একটুখানি জল নিজের মাথায় দিলাম, খানিকটা খেলাম৷ সামান্য ধাতস্থ হয়ে ভাবলাম একবার নীচে যাই৷
কোনোমতে একটু একটু করে সিঁড়ির রেলিং ধরে নামছি, দেখি দিভাইয়ের ঘরের দরজা আজ অন্যদিনের মতো বন্ধ নয়, খোলা৷ ঘরের ভেতর থেকে একটা নীল আলো বাইরে ডাইনিং রুমের মেঝেয় পড়ছে৷ আর সেই আলোতে দেখলাম…’’
থেমে গেল মেয়েটা৷
‘‘কী দেখলে মাধুরী?’’
‘‘দেখলাম…দেখলাম…ওই নীল আলোতে মেঝেতে দুটো মানুষের ছায়া এসে পড়েছে৷ আর ওরা…ওরা যেটা করছে, সেটা…সেটা সেক্স ছাড়া আর কিছু না!’’
আমার দিকে বোবা চোখে তাকিয়ে রইল মেয়েটা৷ বুঝলাম, নিজের চোখে যেটা দেখেছে সেটা ও এখনও বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না!
‘‘এবারে আপনিই বলুন দাদা, নিজের বিয়ে করা বরকে তার নিজের দিদির সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করতে দেখার পরেও কি ও বাড়িতে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল? আমি বাড়িতে এসে মা-বাবাকে কী বলতাম? বলতাম যে আমার বর তার দিদির সঙ্গে শোয়? বলতাম যে সিঁদুর পরতে গেলেই আমি মাথার মধ্যে অদ্ভুত সব স্বর শুনি? বলতাম যে একটা সারা গায়ে পাখির পালকওয়ালা লোক আমাকে রেপ করতে এসেছিল? আমার মা-বাবা আমাকে পাগল ভাবত না?’’
চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লাম৷ এই মুহূর্তে একটা সিগারেট না খেলে আমার মাথাটা খুলবে না৷ মাথাটা অসাড় হয়ে গেছে৷ এমনিতেও আমি আর কিছু শুনতে চাই না, যতক্ষণ না কাকা এসে পৌঁছোচ্ছে৷
বাইরে এসে সিগারেট ধরিয়ে নিশ্চুপে টানতে লাগলাম৷ মাধুরী আমার ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল৷ আকাশের বেশ খানিকটা মেঘে ঢাকা৷ চারিদিকে একটা অস্বাভাবিক দম বন্ধ করা আবহাওয়া৷ দিন দুয়েকের মধ্যেই বৃষ্টি নামবে মনে হয়৷
সিগারেট ফেলে চলে আসছি, এমন সময় কোথাও কিছু নেই হঠাৎ করে আমার ঘাড়ের রোঁয়াগুলো দাঁড়িয়ে গেল৷ মনে হল কলতলার ওপার থেকে কে আমাকে দেখছে৷ ঘুরে দাঁড়াতেই মনে হল সাদা কাপড় পরা একটা অবয়ব ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল৷ আমি তাকাতেই স্যাঁৎ করে অদৃশ্য হয়ে গেল কোথায়৷
প্রবল চিন্তা নিয়ে ঘরে এসে শুলাম৷ যা হচ্ছে ঠিক হচ্ছে না৷ একদমই ঠিক হচ্ছে না৷
* * * *
পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙতে দেরি হল বেশ৷ গত কয়েকদিনের মানসিক উদ্বেগ আমাকে পেড়ে ফেলেছিল একেবারে৷ সেই ক্লান্তি কাটতে কাটতেই সকাল দশটা! ইশ, এত বেলা হয়ে গেল?
বিছানা থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে রুমে আসতেই দেখি দরজার সামনে শ্রীমান মংকুকুমার বত্রিশ পাটি বিকশিত করে দাঁড়িয়ে৷ একটু ধমকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‘কাল ছিলি কোথায় সারাদিন? পাত্তা নেই যে?’’
তিনি কোলগেটের জ্বলন্ত বিজ্ঞাপন হয়ে উত্তর দিলেন, ‘‘পরাগদা একটা কাজ দিয়েছিল৷ তাই আসতে পারিনি৷’’
রেগে গিয়ে দুটো কড়া কথা বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলাম৷ হাজার হোক, মংকু আমার মাইনে করা কর্মচারী নয়৷ কাকুর আদেশে আমাকে একটু সাহায্য করছে এইমাত্র, তাও বিনা পয়সায়৷ রোজ রোজ অফিসের বাবুদের মতো সকাল নটায় আমার দরজায় এসে ‘গুড মর্নিং’ বলে দাঁড়াবে, এতটা আশা করা অন্যায় নয় কি?
একটু নরম হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘তাহলে আজ কী মনে করে? পরাগদা আজ কোনো কাজ দেয়নি তোমাকে?’’
কথাটার জবাব দিল না মংকু, শুধু চোয়ালটা আরও চওড়া করে বলল, ‘‘একজন বাবু শিলিগুড়ি থেকে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন৷ বাইরের ঘরে বসে আছেন৷ বাবু আপনাকে খবর দিতে বললেন৷’’
বুকটা ধক করে উঠল৷ কাকা এসে গেলেন নাকি? কাকু-কাকিমাকে আমার বলাই ছিল ওঁর আসার ব্যাপারে৷ কিন্তু এত তাড়াতাড়ি আসার তো কথা না! শিলিগুড়ি থেকে ট্রেন ডিব্রুগড় অবধি টাইম নেয় প্রায় ষোলো ঘণ্টা৷ কাকার সঙ্গে কথা হয়েছে কাল সকাল এগারোটা নাগাদ৷ উনি যদি তখনই রেডি হয়ে বেরোন, তাতেও ট্রেন ধরতে ধরতে বিকেল৷ মানে এখানে আসতে আসতে আজ প্রায় সন্ধেবেলা হওয়ার কথা৷ এত সকালে পৌঁছোনোর তো প্রশ্নই ওঠে না৷ নাকি কাকার বদলে অন্য কেউ দেখা করতে এসেছেন?