‘‘কী সেটা?’’
মাথা নীচু করে রইল মাধুরী৷ বুঝলাম খুব জটিল কিছু বলতে চলেছে আমাকে৷
‘‘যেদিন সবকিছু গুছিয়ে এ বাড়িতে চলে আসি, তার আগের দিনের ঘটনা৷ রাতের খাওয়ার শেষে আমি ওপরে এসে শুয়েছি৷ একটু তন্দ্রামতন এসেছে কি আসেনি, এমন সময় কানের কাছে ফের শুনতে পেলাম সেই ডাক, ‘আমাদের বারণ শোন মেয়ে, ও সিঁদুর পরিসনি, ও সিঁদুরে বিষ আছে, ও সিঁদুর মহা সর্বনাশী…’ আমি শুনতে শুনতে যেন আরও গভীর ঘুমের মধ্যে তলিয়ে যেতে লাগলাম৷ আমার মনে হতে লাগল আমার শরীর যেন অবশ হয়ে আসছে৷ হাতে-পায়ে একদম সাড় নেই৷ অথচ হুঁশ কিন্তু আবছা হলেও আছে৷
মড়ার মতো খাটে শুয়ে আছি, এমন সময় মনে হল কে যেন ধীরপায়ে দরজা খুলে ঘরের মধ্যে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল৷ একইসঙ্গে অদ্ভুতভাবে বন্ধ হয়ে গেল মাথার দিকের জানলাটাও৷ ঘরের মধ্যে একটা গা ছমছমে অন্ধকার৷ আমার হঠাৎ করে খুব শীত করতে লাগল৷
প্রথমে ভাবলাম বুঝি অনির্বাণই এসেছে বাইরে থেকে৷ তার পরমুহূর্তেই ভুল ভেঙে গেল৷ ওর পায়ের শব্দ আমি চিনি৷ কিন্তু এখন যে ঢুকেছে তার হাঁটাচলার কোনো শব্দ নেই৷
বুঝতে পারলাম যে লোকটা, সে যেই হোক না কেন, নিঃশব্দে আমার দিকে এগিয়ে আসছে৷
আমার গা-টা কেমন যেন একটু শিউরে উঠল প্রথমে৷ ঘরের ভেতর সবকিছু একদম চুপচাপ, পাখা ঘোরার আওয়াজটাও শোনা যাচ্ছে না৷ সেই স্তব্ধ অন্ধকারের মধ্যে দেখলাম যে লোকটা আমার ওপর ঝুঁকে এসে আমাকে দেখছে ভালো করে৷ সঙ্গে সঙ্গে একটা নোংরা পচা বিচ্ছিরি গন্ধে আমার নাক বন্ধ হয়ে এল প্রায়৷ আমি মুখটা সরিয়ে নিতে চাইলাম, কিন্তু ঘাড়টা স্টিফ হয়ে রইল৷’’
আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল প্রায়৷ ‘‘কী সাংঘাতিক! তারপর?’’
‘‘তারপর লোকটা একহাতে আমার আঁচলটা টেনে মাটিতে ফেলে দিল৷ তারপর দুহাতে আমার ব্লাউজ ছিঁড়ে ফেলল৷’’
ঘরের মধ্যে কোনো শব্দ নেই, দেওয়ালঘড়ির টিকটক ছাড়া৷ আমি ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছি৷ আমার রক্ত গরম হয়ে উঠেছে৷ হাতের মুঠো শক্ত৷
ভাবলেশহীন ভাবে বলে যেতে লাগল মাধুরী, ‘‘আমি ছিটকে উঠতে গিয়েও পারলাম না৷ আমার শরীর শক্ত হয়ে থাকল কাঠের মতো৷ লোকটা ধীরেসুস্থে আমার ওপর ঝুঁকে এল৷ আর তখনই ওর চোখদুটো নজরে এল আমার৷ বাপস রে!’’ চেয়ারে বসেই থরোথরো করে কেঁপে উঠল মাধুরী৷
প্রবল উত্তেজনায় ঝুঁকে এলাম আমি, ‘‘কেমন দেখতে লোকটাকে?’’
‘‘আমার দু’চোখ বন্ধ হয়ে এসেছে, সেটা প্রবল ভয়ে না ঘেন্নায় বলতে পারব না, তার মধ্যেই দেখলাম যে লোকটার গায়ের রং কালো৷ কুচকুচে কালো, কয়লার ওপর আলকাতরা লেপে দেওয়ার মতো কালো৷ অত কালো মানুষ আমি জন্মে দেখিনি৷’’
‘‘তুমি ঠিক দেখেছ?’’
‘‘একদম৷’’ বলতে বলতে হাঁপাচ্ছিল মাধুরী৷ ওর দু’চোখ বিস্ফারিত, ফর্সা চোখমুখ লাল হয়ে এসেছে৷ নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে শিশিরের মতো৷ একটু ঝুঁকে এসেছে মেয়েটা, বুকের আঁচল সরে গেছে অনেকখানি৷ শঙ্খের মতো সাদা স্তনবিভাজিকাটি আমার লোভী চোখের সামনে উন্মুক্ত৷ আমি দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলাম৷
‘‘তারপর লোকটা আমার শাড়িটা সায়াসুদ্ধু কোমরের ওপর তুলে দিল৷ প্যান্টিটা খুলে নামিয়ে দিল গোড়ালি অবধি৷ তারপর আমার ওপর চড়ে বসল৷
আমি আতঙ্কে শিউরে উঠলাম, বুঝতে পারলাম যে লোকটা কী করতে চাইছে৷ কিন্তু আমি অসহায়, আমার চৈতন্য আছে সাড় নেই, বোধ আছে কিন্তু শক্তি নেই৷ অসহায়, নিষ্ফল আক্রোশে আমার সমস্ত শরীর ফেটে পড়তে চাইছে, কিন্তু আমি পারছি না৷
লোকটা অতি ধীরে আমার সারা শরীর ঘাঁটতে লাগল৷ ঘেন্নায়, কষ্টে আর অসহায়তায় আমার সমস্ত শরীর গুলিয়ে উঠল৷ আমার সমস্ত শরীর মোচড়াতে লাগল৷ মনে হল এক্ষুনি, এই মুহূর্তে আমি মরে যাচ্ছি না কেন৷
তারপর লোকটা আমার ওপর ঝুঁকে এল৷ আমার চুলের মুঠিটা ধরে আমার মুখটা ওর দিকে ফেরাল৷’’
দেখি মাধুরীর সর্বাঙ্গ ভিজে গেছে ঘামে৷ চোখদুটো বিস্ফারিত, সমস্ত মুখ লাল, হাত-পা থরথরিয়ে কাঁপছে৷ খেয়াল করলাম আমার বুকের মধ্যেও একটা বন্য ক্রোধ হিংস্র অজগরের মতো মাথা তুলছে৷ নিজের নখগুলো ধারালো হয়ে কেটে বসছে নিজেরই চামড়ার ওপর৷ কানের দু’পাশ দিয়ে আগুনের হলকা বইছে যেন৷
‘‘তারপর কী হল মাধুরী?’’
আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকাল মাধুরী৷ সেই ভয়াবহ উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি আমি জীবনে ভুলব না৷
‘‘দেখলাম দু’জোড়া বড় বড় হলদেটে চোখ আমার দিকে তাকিয়ে৷ আর চোখের মণিদুটো লাল, টকটকে লাল৷’’
নিজের বুকের ধকধক শব্দটাও পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছিলাম৷ মনে হল হৃৎপিণ্ডটা যেন আমার গলায় উঠে আসবে৷
‘‘লোকটা সেই গনগনে লাল চোখ মেলে আমার দিকে তাকিয়ে৷ তাতে ঘেন্না, রাগ, নিষ্ঠুরতা পেরিয়েও যেটা জেগে আছে সেটা হচ্ছে লোভ৷ নারীশরীরের প্রতি সীমাহীন লোভ৷ পুরুষমানুষের ওই দৃষ্টি আমরা মেয়েরা জন্ম থেকেই চিনি৷ কিন্তু সেই হাড় হিম করা আতঙ্কের মধ্যেও কিন্তু একটা জিনিস আমি লক্ষ করতে ভুলিনি দাদা৷’’
‘‘কী সেটা?’’
‘‘লোকটার সারা শরীরে চামড়া নেই৷ তার জায়গায় যেটা রয়েছে সেটা পালক৷ পাখির পালক৷’’
ঘরের মধ্যে গাঢ় আর টানটান নিঃশব্দ উদ্বেগ৷ সময় যেন সন্ধে পেরিয়ে রাত হওয়ার দিকে গুটিগুটি এগোতে গিয়ে এই ঘরে এসে ধরা পড়ে গেছে৷ ঘরের বালবের আলোটা হঠাৎ করেই একটু স্তিমিত হয়ে এল৷