বিশু গোঁজ হয়ে বসে রইল৷ বোঝা গেল যে ছোকরা বিলক্ষণ চটেছে৷ তাই শান্তির জল ছেটাবার প্রচেষ্টায় এবার নামতে হল সর্বজনপ্রিয় রঘুকে, ঠান্ডা মাথার ছেলে বলে বাজারে যার বেশ সুনাম আছে৷ স্ট্রাইকার দিয়ে একটা ঘুঁটি তাক করতে করতেই বলল, ‘‘আহা বলই না বাবা৷ আমাদের কি আর তোর মতো কপাল? নাকি তোর মতো ক্যালি আছে? আমাদের ওই শুনেই একটু শান্তি৷’’
একটু ঠান্ডা হল ছোঁড়া, খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘‘অন্য কারও সঙ্গে নয়৷ নিজের বরের সঙ্গেই চলে গেছে!’’
শুনে সবাই তো যাকে বলে স্তম্ভিত! প্রথমে আর্তনাদ করে উঠল শিবুই, ‘‘নিজের বরের সঙ্গে চলে গেছে মানে? এবার তুই একজন বিবাহিতা মহিলার সঙ্গে প্রেম করছিলিস?’’
ছোকরা একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে হ্যাঁ-সূচক ঘাড় নাড়ল৷ বাকিরা তো বিস্ময়ে একেবারে থ!
ইত্যবসরে খুক খুক করে কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিলেন চাটুজ্জেমশাই৷ তারপর বললেন, ‘‘আমাদের বিশুবাবু এবার বেশ জটিল প্রেমজালে জড়িয়েছিলেন মনে হচ্ছে? তা ভালো, চলতি কথায় বলে যার সঙ্গে মজে মন, কী বা হাড়ি কী বা ডোম!
তবে একটা কথা বলি বাবা৷ নিষিদ্ধ প্রেম হল নিষিদ্ধ নেশার মতো, বুঝলে তো৷ নেশা করার থেকে নেশা লুকোবার ব্যাপারটাতেই লোকে মজে বেশি৷ তাতে অবশ্য ঝুঁকি কম নয়৷ ধরা পড়লে হেনস্থা, পাড়ায় ছিছিক্কার, আত্মীয়-প্রতিবেশীদের কাছে মাথা নীচু হওয়া তো আছেই৷ সেরকম হলে প্রাণের ঝুঁকিও বড় কম থাকে না৷ প্রায়শই খবরের কাগজে এই নিয়ে খুনখারাপির খবর লেগেই থাকে, দেখেছ নিশ্চয়ই৷ যৌন ঈর্ষা বড় আদিম মনোবৃত্তি, মুহূর্তেই তা মানুষকে অন্ধ দানব বানিয়ে দিতে পারে৷ এই ফাঁদে একবার যে পা দিয়েছে তার সঙ্গে উন্মত্ত খ্যাপা ষাঁড়ের কোনো তফাত নেই হে, তখন সে যা খুশি তাই করতে পারে৷’’
ধরতাইটা ধরে নিল গদাই, ‘‘এই নিয়ে আপনার ঝুলিতে কোনো অভিজ্ঞতা আছে নাকি দাদা? থাকলে ঝেড়ে ফেলুন না৷ বর্ষার রাতে এসব চাদরচাপা গল্প জমবে ভালো৷’’
চাটুজ্জেমশাই জানালার বাইরের দিকে চেয়েছিলেন৷ হ্যারিকেনের আলোয় তাঁর লম্বা ছায়া দেওয়ালের ওপর জোলো বাতাসে অল্প অল্প কাঁপছিল৷ সেদিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে একটা গোল্ড ফ্লেক ধরালেন তিনি৷ তারপর দেশলাইয়ের কাঠিটা নিভিয়ে জঙ্গলে আমার সঙ্গে যা যা হয়েছিল, সেসব মনে পড়লে এখনও ভয়ে কেঁপে উঠি৷ মানুষ যৌন ঈর্ষায় একবার হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে গেলে কী যে করতে পারে তার ইয়ত্তা নেই!’’
বলা বাহুল্য বাকিরা আরও ঘন হয়ে এল চাটুজ্জেমশাইয়ের কাছে৷ এই বৃষ্টির সন্ধেবেলায় এরকম একটা জমাটি গল্পের থেকে ভালো আর কী হতে পারে? চাটুজ্জেমশাইও গোল্ড ফ্লেকে একটা লম্বা টান দিয়ে শুরু করলেন৷
‘‘তখন আমি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে উত্তর আসামের বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছি…’’ হরির চায়ে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে শুরু করলেন চাটুজ্জেমশাই, ‘‘সদানন্দকাকু জানেন যে আমি ছুটি কাটাতে এসেছি৷ কিন্তু আমার লক্ষ্য একটাই, গোলকপুষ্প৷’’
‘‘কী বললেন? কীসের পুষ্প?’’ কথাটা শুধু রঘু নয়, আরও অনেকেই শুনতে পায়নি মনে হল৷
‘‘গোলকপুষ্প৷ ইয়ারসাগুম্বার একটা ভ্যারিয়েন্ট৷’’
‘‘কীসের ভ্যারিয়েন্ট খুঁজছেন বললেন? কীসের গুম্ফা?’’ বিস্মিতস্বরে প্রশ্ন করল গদাই৷ আমরাও হতভম্ব!
‘‘গুম্ফা নয়, গুম্বা৷ ইয়ারসাগুম্বা৷’’ কঠোর চোখে গদাইয়ের দিকে তাকালেন চাটুজ্জেমশাই, ‘‘এই ইয়ারসাগুম্বা বা ক্যাটারপিলার ফাঙ্গাস হচ্ছে প্রকৃতির এক আশ্চর্য আবিষ্কার, পৃথিবীর সবচেয়ে দামি ঔষধিও বটে৷ শ্বাসকষ্ট থেকে শুরু করে কিডনি আর লিভারের বিভিন্ন রোগ সারাতে এর জুড়ি নেই৷ তবে যে বিশেষ গুণটির জন্য পৃথিবীজোড়া আয়ুর্বেদিক মেডিসিনের বাজারে এর বিপুল খ্যাতি’’, গলাটা একটু নীচু করলেন চাটুজ্জেমশাই, ‘‘সেটা হচ্ছে যৌন সক্ষমতা৷ পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে মানুষের যৌন তাড়না এবং যৌন সক্ষমতা বাড়াতে এই ভেষজ অ্যাফ্রোডিজিয়াকটির জুড়ি নেই৷ এর ইংরেজি নামই হচ্ছে হিমালয়ান ভায়াগ্রা৷’’
‘‘কোথায় পাওয়া যায় এ জিনিস?’’ প্রশ্ন করল ভজা৷
‘‘এ কি আর বাজারে পাওয়ার জিনিস হে? অতি দুষ্প্রাপ্য, অতি দুর্মূল্য বস্তু৷ পাওয়া যায় একমাত্র তিব্বতের দিকেই, সি-লেভেল থেকে সাড়ে তিন হাজার ফিট উচ্চতার ওপরে৷ একটু নেমে এলে অবশ্য নেপালেও পাওয়া যায়৷ স্থানীয়রা বলে কীড়াজড়ি৷’’
‘‘জিনিসটা দেখতে কীরকম?’’ গল্পের গন্ধে গন্ধে ক্যারম পেটানো থামিয়ে রঘুও এগিয়ে এসেছে এদিকে৷
‘‘জিনিসটা দেখতে অবশ্য একটু অদ্ভুত, বুঝলে৷ দৈর্ঘ্যে আর আকারে বেশি বড় না, ধরো এই দেশলাই কাঠির সাইজের হবে৷’’
‘‘তা মহার্ঘ বললেন কেন?’’ কৌতূহলী হল বংশী৷ ওর ওষুধ ডিস্ট্রিবিউশনের ব্যবসা৷
‘‘মহার্ঘ কেন?’’ অল্প হাসলেন চাটুজ্জেমশাই, ‘‘ও বস্তুটির এক কিলোর দাম, তা ধরো এখনকার বাজারে ষাট থেকে পঁয়ষট্টি মতো হবে৷’’
‘‘ষাট থেকে পঁয়ষট্টি বলতে?’’
‘‘লাখ৷’’
‘‘লাখ? ষাট-পঁয়ষট্টি লাখ?’’ শুনে আমরা তো হাঁ! ‘‘মানে এক গ্রামের দাম ছয় থেকে সাত হাজার টাকা? এ-এ-এ তো…’’ বলতে গিয়ে তুতলে যায় শিবু৷
‘‘সোনার থেকেও দামি’’, মৃদু হাসলেন চাটুজ্জেমশাই৷
‘‘তা এই কীড়াজড়ি ওরফে ইয়ারাসাগুম্বার ব্যাপারে আমরা আয়ুর্বেদিক লাইনের লোকজনেরা সবাই মোটামুটিরকম জানি৷ আমি যে সময়ের কথা বলছি সে ধরো তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার কথা৷ তখনও এইসব ভায়াগ্রা-টায়াগ্রা আবিষ্কার হয়নি৷