কেন জানি না ওটা আর নেড়েঘেঁটে দেখতে ইচ্ছে করল না৷ আমি মশারি টাঙিয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম৷ তখনও অনির্বাণ শুতে আসেনি৷ কিছুক্ষণ মনে মনে গজগজ করলাম, নবাবপুত্তুরের এমন কী অভিমান যে এখনও শুতে আসতে পারছেন না?
খানিকক্ষণ এপাশ-ওপাশ করার পর উঠে বসলাম৷ হাতঘড়িটা মাথার কাছেই ছিল, দেখি প্রায় বারোটা বাজে৷ এখনও শুতে এল না লোকটা?
ও বাড়ির দোতলায় একটাই ঘর, আমাদের৷ ভাবলাম বাবু বুঝি অভিমান করে ছাদে হাওয়া খেতে গেছেন৷ বিছানা থেকে নেমে দেখি না, তা নয়৷ দোতলাটা ফাঁকা৷ ছাদে যাওয়ার দরজা তালাবন্ধ৷ একতলায় দিভাইয়ের ঘরে আলো জ্বলছে৷ সেখান থেকে কথাবার্তার মৃদু আওয়াজ ভেসে আসছে৷ একটু পরেই দেখি অনির্বাণ বেরিয়ে আসছে৷ আমি একটু সরে এলাম৷ দিভাইয়ের ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে গেল৷
অনির্বাণ শুতে এলে আমি আর দেরি হওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলাম না, এমনই অভিমান হয়েছিল ওর ওপর৷ হোক যতই ঝগড়াঝাঁটি, তাই বলে মাঝরাত অবধি সেসব দিদিকে বলতে হবে?
পরের তিন-চারটে দিন এইভাবেই গেল৷ সকাল থেকে উঠেই অশান্তি, ঝগড়া শুরু৷ কেউ কারও সঙ্গে বিশেষ কারণ ছাড়া কথাই বলছি না৷ দিভাইও চেষ্টা করে করে হাল ছেড়ে দিয়েছেন৷ সকালে ঠুকঠাক দিয়ে শুরু হয়, বিকেলের পর মারাত্মক আকার নেয়৷ নতুন বউকে দেখতে আসা প্রতিবেশীদের ভিড়ও পাতলা হয়ে এসেছে৷ একদিন শুনলাম কাজের লোক দিভাইকে আড়ালে বলছে, পাড়ায় বলাবলি শুরু হয়েছে, এ কোন খাণ্ডারনি মেয়ে বউ হয়ে এসেছে এ পাড়ায়? শুনে আমার মেজাজ একেবারে সপ্তমে৷ কাজের মেয়েটিকে ডেকে যাচ্ছেতাই করে বললাম৷ সে নিয়ে আবার একপ্রস্থ অশান্তি৷
এদিকে অনির্বাণ রোজই মাঝরাত পার করে শুতে আসছে৷ খাওয়ার পর মাঝরাত অবধি ও দিভাইয়ের ঘরে কাটায়, ঘরের দরজা বন্ধ থাকে৷ আমার মেজাজ যাচ্ছে আরও খিঁচড়ে৷ সবে বিয়ে হয়েছে, হানিমুন কাটিয়ে ফিরেছি৷ কোথায় স্বামীসঙ্গ উপভোগ করব, তার বদলে তাঁর আবার দিদির প্রতি এতই আঠা যে মাঝরাত অবধি আড্ডা না মেরে উনি শুতে আসতে পারছেন না!’’
এইখানে এসে মাধুরীকে থামালাম আমি৷ এই জায়গাটা আমার পক্ষে খুব গুরুত্বপূর্ণ৷
‘‘একটা কথা বলো তো মাধুরী, খোলাখুলি জিজ্ঞেস করছি৷ তোমাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক কেমন ছিল?’’
একটু সোজা হয়ে বসল মাধুরী৷
‘‘দেখুন দাদা, বলতে যখন বসেছি, তখন সবই বলব৷ তা ছাড়া ডাক্তার আর উকিলের কাছে এমনিতেও কিছু লুকোতে নেই৷ আমাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক বিয়ের আগেও এক-দুবার হয়েছে৷ সেদিক দিয়ে আমার বা অনির, কারোরই কোনো অসুবিধা ছিল না৷ বরং এ ব্যাপারে আমাদের মধ্যে চমৎকার বোঝাপড়া ছিল৷ ভুটানের হানিমুনের দিনগুলোতেও আমরা চুটিয়ে একে অপরের সঙ্গ উপভোগ করেছি৷
কিন্তু যেদিন ওদের বাড়িতে ফিরে গেলাম, সেদিন থেকেই মনে হল ওর প্রতি সেই শারীরিক টানটা আর অনুভব করছি না৷ হঠাৎ করেই মনে হল ও একটু বেশি নরমসরম, মেয়েলি গোছের, সেই শক্তপোক্ত পুরুষালি ব্যাপারটা নেই৷ তার ওপর বেঁটে, মাথায় হালকা টাক৷ আমার কাছে ও আর সেই ভালোবাসার অনির্বাণ রইল না৷ ওর শারীরিক খুঁতগুলোই আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিতে লাগল৷’’
‘‘কিন্তু তাতে করে কী…’’
‘‘হ্যাঁ দাদা, তাতে করেই কেমন যেন আমার মনে হতে লাগল যে এই লোকটা আমাকে রাত্রে ছোঁবে? ম্যা গো! প্রথম দিন রাতে আমার কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করতেই কড়া গলায় ওকে বলে দিই আমাকে যেন একদম ডিস্টার্ব না করে৷ ও আর চেষ্টা করেনি৷ অথচ প্রতিরাতে ও যখন দিভাইয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে শুতে আসত, একটা নোংরা ঈর্ষায় আমার বুকটা জ্বলে যেত৷ শুধু মনে হত, এই যৌবন নিয়ে আমি বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছি, আর উনি দিদির ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে এমন কী আড্ডা মারছেন শুনি? অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, যে মুহূর্তে লোকটা আমার ঘরে ঢুকত তক্ষুনি লোকটাকে আমি ঘেন্না করতে শুরু করতাম৷’’
‘‘সে আবার কী?’’ মনে হল হয়তো ঠিক শুনলাম না আমি, ‘‘ঘেন্না করবে কেন? এই যে বললে ঈর্ষায়..’’
‘‘ওটাই তো প্রবলেম দাদা’’, একটা তিক্ত অথচ বিষণ্ণ হাসি খেলে গেল মাধুরীর কমনীয় ঠোঁটদুটি ছুঁয়ে৷ ‘‘যতক্ষণ ও আমার চোখের বাইরে থাকত, ততক্ষণ মনে হত কোথায় গেল লোকটা? খুব অভিমান হত৷ অথচ ও আমার সামনে এলেই অদ্ভুতভাবে ওর প্রতি একটা অন্ধ রাগ জেগে উঠত বুকের মধ্যে৷ মনে হত বোমার মতো ফেটে পড়ে ছারখার করে দিই লোকটাকে৷ আমার সঙ্গেই পুড়ে মরে যাক ও৷’’
জানি না, শেষ কথাটা শুনে আমার বুকের মধ্যে কোথাও অতি সূক্ষ্ম কী একটা টং করে এসে বিঁধল৷ চুপ করে রইলাম৷ ঘরের মধ্যে অখণ্ড নীরবতা৷ দেওয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারটা হাওয়ায় অল্প অল্প উড়ছিল৷ সেখান থেকে একটা ঠকঠক আওয়াজ আসছিল শুধু৷
মাধুরী একটু থেমে ফের বলতে লাগল, ‘‘দিনে দিনে এই অশান্তি বেড়েই চলল৷ প্রতিপদে ওর ভুলগুলো নজরে পড়তে লাগল৷ আর আমার মনে হতে লাগল এই ভুলগুলো ও করবে কেন? কী অধিকার আছে ওর ভুল করার? আমি ওকে সেগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে লাগলাম৷ ও কিছু বললেই খুব রূঢ় ভাষায় জবাব দিতে থাকলাম৷ দিভাইও এক-দুবার মাঝখানে কিছু বলতে এসে অপমানিত হলেন৷ ওই মহিলাকে আমার আর সহ্য হচ্ছিল না৷ এরই মাঝে একদিন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল৷’’