‘‘কেন রে মেয়ে? এমন ভয়ানক দৈবী শক্তি নিয়ে কী করবি তুই?’’
‘‘আমার সবকিছু যে হারিয়ে যাচ্ছে মাই…ওই…ওই ডাইনি যে ছিনিয়ে নিতে এসেছে আমার সবকিছু৷ আমি তা হতে দেব না মাই, আমার সবকিছু হারিয়ে আমি পথের ভিখিরি হতে পারব না৷’’
‘‘শোন রে মেয়ে, নাগযক্ষিণীর জাদু বড় কঠিন জাদু, বড় দুরূহ বিদ্যা৷ শুধুমাত্র মন্ত্রসাধনায় তাকে আয়ত্ত করা যায় না৷ হৃদয় শুদ্ধ না হলে, চিত্ত পবিত্র না হলে, বুদ্ধি প্রসন্ন না হলে তাকে অধিকার করা বড় কঠিন৷ বিন্দুমাত্র বিচ্যুতিতে সে বিদ্যা মুহূর্তে মহাবিষধর নাগ হয়ে দাঁড়ায়, প্রতিশোধস্পৃহায় নিজের প্রয়োগকারীকেই দংশন করে বসে…’’
‘‘জানি রে মাই…’’ নারীটির স্বর অটল, অচঞ্চল, ‘‘তোর মেয়েরা এ সবই জানে৷ এইসব জেনেই আজ আমি জাগিয়েছি তোকে৷’’
‘‘আরেকবার ভেবে নে মেয়ে, যা চাইছিস তার কিন্তু মূল্য বড় সাংঘাতিক৷’’
‘‘বল রে মাই, কী চাস তুই৷’’
‘‘দেওয়ার মতো কী মূল্য তোর কাছে আছে রে মেয়ে?’’
‘‘ধন, সম্পদ, যৌবন, জীবন, সব আছে রে মাই৷ বল মাই, একবার মুখ ফুটে বল, কী বলি চাস তুই৷’’
সময়ের গহ্বর থেকে, মৃত নক্ষত্রের আলো বেয়ে সেই গহিন অরণ্যের বাতাসে ভেসে এল কার অশরীরী উত্তর—
‘‘ভালোবাসা৷’’
* * * *
ঝামেলাটা শুরু করেছিল বিশু-ই, মানে হরেন সাঁপুই-এর বড় ছেলে বিশ্বনাথ৷ কিন্তু সেই মওকায় মঙ্গলবারের সন্ধ্যায় যে অমন একটা হাতে গরম গল্প জুটে যাবে…
সেটা ছিল এক বর্ষার সন্ধে৷ সারাদিন ধরে কখনও মুষলধারে, কখনও টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়েই চলেছে৷ একে পনেরোই অগস্ট হওয়ার দরুন আফিস-কাছারি সব বন্ধ, তার ওপর ট্রেনের লাইনে জল জমে ট্রেনও চলছে না৷ পথঘাট জলে ডুবে একশা, এমনকি এ এলাকার অমন জমজমাট সাহাগঞ্জের বাজারেরও ঝাঁপ বন্ধ বলে খবর৷ চারিদিকে জলে থইথই, কবির ভাষায় চারিদিকে জল শুধু জল৷ দেখে দেখে চিত্ত মোর হয়েছে বিকল৷
মোটমাট এই ঘরবন্দি অবস্থায় তিতিবিরক্ত হতে হতে শেষমেশ পাড়ার কয়েকজন ক্লাবঘরে এসে জমায়েত হয়েছে৷ আড্ডার অনুপান বলতে অবশ্য হরির দোকানের চা আর মুড়ির সঙ্গে গরমাগরম চপ-ফুলুরি৷ তাই নিয়ে গুলতানি চলছে সবার মধ্যে৷
ক্লাবঘরের এককোণে বসে ন’পাড়ার ভজা আর রঘু খুব মন দিয়ে ক্যারম পিটোচ্ছিল৷ বাকিদের আবার ক্যারমে তেমন মন নেই, তারা কয়েকজন মিলে ব্রিজ খেলছিল৷ বাকিরা বলতে বিশু, বংশী, শিবু আর গদাই৷ মধ্যমণি হয়ে অবশ্য বসেছিলেন একজনই, ভবতারণ চট্টোপাধ্যায়, ওরফে চাটুজ্জেমশাই৷
চাটুজ্জেমশাই আমাদের পাড়ায় এসেছেন বেশিদিন নয়৷ চাকরি করতেন ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে৷ ছেলেমেয়ে নেই, স্ত্রী গত হয়েছেন বছর দুয়েক হল৷ তারপরেই ভিআরএস নিয়ে নেন ভদ্রলোক৷ সেই টাকায় মাস ছয়েক আগে তিনি এ পাড়ার মুখুজ্জেদের একতলা পোড়ো বাড়িটা সস্তায় কিনে ফেলেন৷ সেটাকে সংস্কার করে বসবাস করছেন তাও নয় নয় করে তিন-চার মাস হয়ে গেল৷
ভদ্রলোককে দেখলে প্রথম দর্শনে কাশীর ডাঁসা পেয়ারার কথা মনে পড়ে৷ ছোটখাটো রোগাসোগা চেহারা, গায়ের রং টকটকে ফর্সা, আর মাথাজোড়া চকচকে টাক৷ মুখে সবসময়ই একটা শান্ত সৌম্য হাসি লেগেই আছে৷ ভদ্রলোকের বহু গুণের মধ্যে একটা হল আয়ুর্বেদ৷ তা ছাড়া জ্যোতিষচর্চার ওপর দখলও অসামান্য৷ নিরহংকারী সদাশয় মানুষ, কারও সাতেপাঁচে নেই৷ নেশা বলতে শুধু গোল্ড ফ্লেক সিগারেট, দুধ-চিনি ছাড়া কড়া চা আর বই৷
তবে ভদ্রলোকের সবচেয়ে বড় যে গুণটির জন্য তাঁকে ছাড়া এদের আড্ডাটা জমে না, সেটা হচ্ছে গল্পের অফুরন্ত ভাঁড়ার৷ আর সেসব গল্পই রীতিমতো যাকে বলে শিরশিরানি জাগানো ভয়াল ভয়ংকর অলৌকিক গল্প৷
কথা হচ্ছিল অবৈধ প্রেম নিয়ে৷ ব্রিজ খেলতে খেলতেই বিশু আর বংশীর মধ্যে একটা ঝামেলা পাকিয়ে উঠছিল ক্রমেই৷ বিশুর মতে ভালোবাসা ইজ ভালোবাসা, তার আবার বৈধ-অবৈধ কী? ওদিকে বংশীর বক্তব্য, সবাই যদি তাই-ই ভাবে তাহলে তো সমাজ-টমাজ এসব রাখার কোনো মানেই হয় না, অসভ্য জংলিদের মতো বনে-জঙ্গলে গিয়ে থাকলেই হয়! বিশু পালটা দিল, মানবমন অনেক জটিল জিনিস, তাকে নিয়মকানুনের নিগড়ে বেঁধে রাখা অসম্ভব ইত্যাদি৷
বিশুর কথাবার্তা ক্রমেই ক্ষুরধার হয়ে উঠছিল৷ হাজার হোক পড়াশোনা করা বলিয়ে কইয়ে ছেলে৷ ওর সঙ্গে যুক্তিতর্কে বংশী পারবে কেন? শেষমেশ গদাই একটা বিলো দ্য বেল্ট হিট করতে বাধ্য হল, ‘‘হ্যাঁ রে বিশু, তোর লেটেস্ট চিড়িয়ার খবর কী? সে আছে না গেছে?’’
একটু রাগত চোখে এদিকে তাকাল বিশু, তারপর বলল, ‘‘কেন, জেনে কী করবি?’’
‘‘আহা বলই না’’, ফুট কাটল শিবু৷
‘‘নেই৷’’ সংক্ষিপ্ত উত্তর৷
হুল ফুটোল বংশী, ‘‘তা তিনি এবার কার সঙ্গে গেলেন রে বিশু? তোর বন্ধু, নাকি তার বান্ধবীর হাজব্যান্ড?’’
উঠে বসল বিশু, তারপর ক্রুদ্ধস্বরে বলল, ‘‘তাতে তোদের কী বে?’’
‘‘তুই তো আবার হাত দেখতে এক্সপার্ট শুনেছি৷ তা বাপু, মেয়েদের হাত-টাত ধরার আগে একটু বিচ্ছেদ, বিরহ এসব রেখা-টেখাগুলো দেখে নিলে পারিস তো৷’’ এবার গদাই৷
এখানে বলে রাখা ভালো, বিশু হাত দেখতে জানে৷ সেজন্য মেয়েমহলে ওর একটা বাড়তি খাতিরও আছে৷ লোকে অবশ্য বলে ওর হস্তরেখা শিক্ষা নাকি ওই উদ্দেশ্যেই৷ তবে ছোকরা আপাতত চাটুজ্জেমশাইয়ের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে আরও কিছু শেখার ধান্দায়৷