‘‘তা দেখেছি বই কি! আমার কাছে ওষুধ নিতে বা কোষ্ঠীবিচার করাতে তো কম লোক আসেন না৷ তাঁদের কাছে যেসব গল্প শুনি, লিখতে পারলে একটা মহাভারত হয়ে যেত৷’’
চুপ করে গেল মাধুরী৷ ফের সেই অন্যমনস্ক ভাব৷ দেওয়ালের দিকে চেয়ে আছে৷ কপালে ভ্রূকুটি, চোখে চিন্তিত দৃষ্টি৷ যেন কোনো কিছু মনে করার চেষ্টা করছে৷
‘‘কী হল মাধুরী? কিছু ভাবছ?’’
আমার এই কথায় সাড় ফিরে এল মাধুরীর মধ্যে৷ যেন অতল চিন্তার সমুদ্র সাঁতরে পারে এসে পৌঁছোল সে৷ আর তার সঙ্গে সঙ্গে সেই গন্ধটা ফের নাকে এল আমার৷
ভিজে কাঠ পোড়ার গন্ধ৷ কটু, ভ্যাপসা, শ্বাসরুদ্ধকর একটা গন্ধ৷
‘‘আমি…আমি…বুঝতে পারছি না কীভাবে বলব৷ মানে বিষয়টা যেমন অদ্ভুত, তেমনই…তেমনই নোংরা…আর আর…’’
নড়েচড়ে বসলাম৷
‘‘কাউকে বলে বোঝানো যাবে না দাদা৷ যাকে বলব সেই বলবে হয় আমি পাগল…নইলে আমি…আমি…ইচ্ছে করে খুব খারাপ কিছু ভাবছি…আমি একটা অত্যন্ত নোংরা মনের মেয়ে৷’’
‘‘সেইজন্যই কি নিজের মা-বাবাকেও কিছু বলোনি এই নিয়ে?’’
মাথা নাড়ল মাধুরী৷
‘‘হুম৷ তুমি এক কাজ করো৷ শুধু ঘটনাগুলো আমাকে পরপর বলে যাও৷ খারাপ না ভালো, সে বিচারের ভার নাহয় আমি নিলাম৷’’
আরও খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর মুখ খুলল মাধুরী৷
‘‘আমাদের বিয়ের গল্প তো শুনেইছেন৷ অনির্বাণের সঙ্গে আমার আলাপ আমার এক বান্ধবীর জন্মদিনের পার্টিতে৷ আমাদের মধ্যে আলাপ-পরিচয় ভালোবাসায় গড়াতে দেরি হয়নি বেশি৷
মা-বাবা যখন আমার জন্য সম্বন্ধ দেখা শুরু করেন, আমিই বলি অনির্বাণের কথা৷ ছেলে হিসেবে অনি খুব ভালো৷ দেখতে ভালো, পড়াশোনায় ভালো৷ ভালো চাকরি করে৷ মা-বাবার না করার কোনো কারণ ছিল না৷
বিয়ের আগেও আমি ওদের বাড়ি বারকতক গেছি৷ অনির দিদির সঙ্গে আমার তখনই আলাপ৷ অনিই শিখিয়েছিল ওর দিদিকে দিভাই বলে ডাকতে৷
দিভাইয়ের বিয়ে হয়েছিল ওদের মামাবাড়ির দিকের কোনো এক দূরসম্পর্কের রিলেটিভের সঙ্গে৷ জানি না জানেন কি না, অনির মা ছিলেন এখানকার লোক, মানে আসামিজ৷ অনির বাবা কলকাতা থেকে চাকরিসূত্রে এখানে চলে আসেন সত্তরের শেষাশেষি৷ শেষে অনির মাকে বিয়ে করে এখানেই থিতু হন৷ উনি মারাও যান এখানেই৷’’
‘‘কবে?’’
‘‘অনি যে বছর ক্লাস টেনের বোর্ড এক্সাম দেয়, সেই বছর৷ দু’হাজার চার৷’’
‘‘আর অনির মা?’’
‘‘তিনি মারা যান তার তিন বছর পর৷ অনি তখন ফার্স্ট ইয়ারে৷’’
‘‘হুম৷ আর ওর দিদি? তিনি তখন কোথায় ছিলেন?’’
‘‘দিভাইয়ের হাজব্যান্ডও সেই বছরেই মারা যান৷ অনি একা আছে দেখে দিভাই এ বাড়ি চলে আসেন৷ সে যাই হোক৷ এবার আসল কথায় আসি৷
ফুলশয্যার পরের দিন সকালে স্নান-টান করে আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছি, এমন সময় দিভাই এসে আমার হাতে একটা পাথরের মূর্তি দিয়ে বললেন, ‘এইটে নিজের শোওয়ার ঘরে রাখিস মাধু৷ আমার মায়ের দেওয়া জিনিস৷ তোর ভালো হবে৷’
তাকিয়ে দেখি একটা কোনো দেবীমূর্তি, সাইজে আড়াই-তিন ইঞ্চির বেশি হবে না৷ সারা গায়ে তেল আর সিঁদুর লেপা বলে ভালো করে বোঝাও যাচ্ছে না৷ আমি কিছু না ভেবে আলমারির পাশে একটা তাকে তুলে রাখলাম৷
পরের দিন ছিল চোদ্দোই ফেব্রুয়ারি৷ আমাদের হানিমুন কাটাতে ভুটান যাওয়ার কথা৷ গোছগাছ করে বেরোতে বেরোতে দুপুর হয়ে গেল৷ দিভাইও বেরিয়ে গেলেন গুয়াহাটি যাবেন বলে, ওখানে নাকি কীসব অফিশিয়াল কাজকম্ম আছে৷
আমরা ভুটান থেকে ফিরলাম ছ’দিন বাদে, তারিখটা এখনও মনে আছে, বিশে ফেব্রুয়ারি৷ দিভাই তার আগের দিনই গুয়াহাটি থেকে ফিরেছেন৷ আমি পরের দিন সকাল সকাল বাপের বাড়ি চলে আসি৷ কারণ দু’দিন বাদে ছিল শিবরাত্রি৷ ইচ্ছে ছিল বিয়ের পর প্রথম শিবরাত্রিটা বাড়িতেই কাটিয়ে পরের দিনই আমি সদিয়ার বাড়ি চলে যাব৷ তারপর ওখানে দিনকয়েক কাটিয়ে অনির সঙ্গে ডিব্রুগড়ে ব্যাক করব৷
সে যাই হোক৷ এ বাড়িতে এসে দুপুর নাগাদ স্নান করে আয়নার সামনে বসেছি৷ সিঁদুরটা পরতে যাব, এমন সময়ে মনে হল…’’
বলে থমকে গেল মাধুরী৷ আমি তাড়া দিলাম, ‘‘কী হল, থামলে কেন? বলো!’’
আমার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকাল মাধুরী৷ তারপর বলল, ‘‘মনে হল, কে যেন আমার কানে কানে বলছে, ‘ও সিঁদুর পরিসনি মেয়ে৷ ও সিঁদুরে অভিশাপ আছে৷ ও সিঁদুর বড় অলুক্ষুণে’৷’’
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে রইলাম৷ মেয়েটা স্কিজোফ্রেনিক নাকি?
আমার মনের কথাটা বোধহয় কিছুটা আঁচ করতে পারল মাধুরী৷ প্রশ্ন করল, ‘‘আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই না? আমার নিজেরই বিশ্বাস হয়নি৷ তাই তো মা-বাবাকে এসবের কিছুই বলিনি৷’’
‘‘দ্যাখো, এসব কথা যে চট করে বিশ্বাস করা মুশকিল সে তো বোঝোই৷ হতে পারে তোমার অবচেতনে হয়তো কোনো জটিল চিন্তা কাজ করছিল, তাই হয়তো নিজে নিজেই…’’
‘‘তাই বলে তিনদিন? পরপর তিনদিন? ঠিক সিঁদুর পরার সময়টাতেই?’’
থমকে গেলাম৷ ‘‘তিনদিন ধরে তুমি একই কথা শুনলে?’’
‘‘একদম দাদা৷ স্পষ্ট শুনলাম৷ ঠিক সিঁদুরটা পরতে যাব, তখনই৷’’
‘‘হুম৷ তারপর?’’
‘‘তারপর শিবরাত্রির দিন সারাদিন উপোস করে রাত্রিবেলায় সামান্য ফল আর সাবুদানা খেয়ে উপোস ভাঙলাম৷ শরীরটা প্রচণ্ড ক্লান্ত ছিল, তাই ঘুমিয়ে পড়তে দেরি হয়নি বিশেষ৷’’
বলে থমকে গেল মেয়েটা৷