‘‘আগেই বলেছি, পাতরগোঁয়্যাদের বসবাস ছিল অন্যদের থেকে বেশ একটু দূরে৷ তার ওপর পুরো গ্রামটাই ছিল বাঁশের উঁচু বেড়া দিয়ে ঘেরা৷ সামনে মস্ত বড় একটা শালকাঠের দরজা৷ বাইরের লোকজন ওখানে গিয়ে আওয়াজ দিলে দরজাটা খুলে যেত৷
সেই অমাবস্যার দিন, গাঁওবুড়োরা যখন ওদের গ্রামে গিয়ে পৌঁছোয় তখন বিকেল পেরিয়ে সন্ধে নামছে৷ গিয়ে দ্যাখে চারিদিকে সব কিছু নিঝুম৷ অত বড় গ্রাম থেকে শুধু একটা আওয়াজই ভেসে আসছে, একটা বাচ্চার কান্নার শব্দ৷ এ ছাড়া চারিদিক একেবারে শুনশান৷
লোকজন গিয়ে প্রথমে দরজায় ঠক ঠক করে৷ তারপর তাতে কারও সাড়াশব্দ না পেয়ে হাঁকডাকও করে কিছুক্ষণ৷ তাতেও কাজ না হওয়ায় শেষমেশ জোয়ান মদ্দরা মিলে দরজাটা একটু জোরে ধাক্কা মারে, আর দরজাটা নিজে নিজেই হাট হয়ে খুলে যায়৷’’
তারপর কিছুক্ষণের নৈঃশব্দ্য৷ আমি আর মংকু একেবারে চুপ৷
‘‘ভেতরের দৃশ্য দেখে সবাই খানিকক্ষণ হাঁ করে থাকে৷ তারপর দুদ্দাড় করে যে যেদিকে পারে ছুটে পালায়৷’’
‘‘কেন?’’ প্রশ্ন করার সময় বুঝতে পারছিলাম যে আমার হৃৎপিণ্ডটা ধকধক করছে৷
‘‘কারণ ওরা দ্যাখে যে গ্রামের মধ্যে কোথাও কোনো মানুষের চিহ্নমাত্র নেই৷ এমনকি সামনেই যে দেওথান, সেটাও ফাঁকা৷ দেওথানের সামনে একটা গাছ থেকে ঝুলছে সেই অভিশপ্ত বড়দেওরির দেহ, আর তার বাচ্চা মেয়েটা মায়ের পায়ের কাছে বসে কাঁদছে৷ ব্যস, এই ছাড়া মানুষজন বলতে কেউ নেই, কোত্থাও নেই, কিচ্ছু নেই৷ তার বদলে সারা গ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে আছে শুধু ওরা৷’’
‘‘কারা?’’
বোধহয় নিজের অজান্তেই গলাটা নীচু হয়ে গেল পরাগের, ‘‘কাক৷ গোটা গ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে আছে অগুনতি কাক৷ তাদের সবার চোখ লাল, সবার ঠোঁটে রক্ত৷’’
* * * *
বিকেলে নিজের ঘরের আরামকেদারায় বসে গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিলাম৷ ঘটনা যেভাবে জট পাকিয়ে উঠেছে সেটা একবার ঠান্ডা মাথায় বুঝে নেওয়া দরকার৷
গত কালকের অভিজ্ঞতা আর আজকে শোনা গল্পটা মেলাতে বেশি বুদ্ধির দরকার হয় না৷ পরাগের বক্তব্য অনুযায়ী, শুখানালার ওপারেই ছিল পাতরগোঁয়্যাদের গ্রাম৷ মানে এখন যেখানে কাউরীবুড়ির মন্দির৷ সেই মন্দিরের প্রধান সেবায়েত ছিলেন মহিলারা৷ বংশানুক্রমে নয়, মাতৃ-অনুক্রমে৷ পরাগের বয়ান অনুসারে, কাউরীবুড়ির অভিশাপে পাতরগোঁয়্যাদের গ্রাম ছারখার হয়ে যায়, শুধু দেবীর অভিশাপ পূরণ করার জন্যই বড়দেওরির কন্যাটি বেঁচে থাকে৷
ওদিকে কাউরীবুড়ির মন্দিরের মহিলাটি বলেছিলেন একমাত্র তাঁদের পরিবারের মেয়েরা ছাড়া অন্য কারও সেখানে যাওয়া নিষেধ৷ হতেই পারে যে ইনিই সেই পাতরগোঁয়্যাদের বড়দেওরির উত্তরসূরি৷ তিনি এখনও তাঁদের পারিবারিক অভিশাপের উত্তরাধিকার বহন করে চলছেন৷ আর সেই থেকে দেওরিদের বাকি উপজাতিরা কাউরীবুড়ির থানকে যমের মতো ডরায়, সন্তর্পণে এড়িয়ে চলে৷
তবে যেটা আমাকে ভাবাচ্ছিল সবচেয়ে বেশি, সেটা হচ্ছে কাক৷ আজ অবধি কাকেদের আমি অত অদ্ভুত আচরণ করতে দেখিনি, যা কাল দেখলাম৷ কাউরীবুড়ির মন্দিরে অত কাক কী করছিল? তাদের অমন ভয়ংকর চাউনি কেন?
অত বছর আগে পাতরগোঁয়্যাদের গ্রামে ওরা অত কাক দেখেছিল কেন? কী হয়েছিল পাতরগোঁয়্যাদের? কীভাবে উধাও হয়ে গেল ওরা?
হয়তো চিন্তায় অত্যধিক মগ্ন হয়ে থাকার কারণেই খেয়াল করিনি যে মাধুরী কখন ঘরে ঢুকে পড়েছে৷ তাই ও যখন জিজ্ঞেস করল, ‘‘কী বিড়বিড় করছেন?’’ আমি তখনও ধাতস্থ হইনি৷ আনমনে ওর দিকে চেয়ে পালটা প্রশ্ন করে ফেললাম, ‘‘কাউরীবুড়ির মন্দিরে গেছ কখনও?’’
প্রশ্নটা শুনে হেসেই ফেলল মাধুরী, ‘‘ধুত, কী যে বলেন! কাকের আবার মন্দির হয় নাকি?’’
কথাটা মাথায় সেঁধোতে একটু সময় নিল, ‘‘কাকের মন্দির কখন বললাম? বললাম যে কাউরীবুড়ির…’’
‘‘ওই হল৷ অসমিয়া ভাষায় কাউরী মানে কাক৷’’
কথাটা শুনে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো সোজা হয়ে বসলাম৷ কাউরী মানে কাক? তার মানে কাউরীবুড়ি আসলে কাকেদের দেবী? মাই গুডনেস!
পরক্ষণেই নিজেকে সংযত করে নিলাম৷ এখন আমার কাজ অন্য৷ কাউরীবুড়ি রহস্য নিয়ে না হয় পরে ভাবা যাবে৷
সোজা হয়ে বসে মাধুরীকে সামনের চেয়ারে বসতে বললাম৷ তারপর প্রশ্ন করলাম, ‘‘এবার বলো তো তোমার সঙ্গে অনির্বাণের কেসটা কী?’’
প্রশ্নটা শুনে মাধুরী খানিকক্ষণ শাড়ির আঁচলটা আঙুলে জড়াল৷ তারপর অস্ফুটে বলল, ‘‘কীভাবে শুরু করব বুঝতে পারছি না৷’’
‘‘টেনশন নেওয়ার কিছু নেই৷ একদম ঠান্ডা মাথায় পরপর বলে যাও৷ কোনো ডিটেইলস বাদ দেবে না৷’’
‘‘না না…টেনশনের ব্যাপার নয়৷ আসলে ব্যাপারটা এমন অদ্ভুত যে আমার নিজের পক্ষেও সেটা বিশ্বাস করা খুব মুশকিল৷’’
‘‘কীরকম?’’
প্রশ্নটার সরাসরি কোনো জবাব দিল না মাধুরী৷ তার বদলে উলটে আমাকে একটা প্রশ্ন করে বসল, ‘‘আচ্ছা দাদা, একটা কথা বলুন, আপনি তো আমার থেকে বয়সে বড়৷ তার ওপর কলকাতার মতো বড় শহরে থাকেন৷ সেখানকার জীবন নিশ্চয়ই আমাদের এই তিনসুকিয়ার থেকে অনেক জটিল?’’
ম্লান হাসলাম, ‘‘সে আর বলতে? বড় শহরের জীবন শুধু জটিল নয়, মাকড়সার জালের মতো৷ সেখানে একবার যদি কেউ আটকে পড়ে, তবে তার আর নিস্তার নেই৷’’
‘‘অনেক রকমের সাংসারিক অশান্তিও দেখেছেন নিশ্চয়ই?’’