কথাটা শুনে থমকে গেলাম৷ লোকটা বলছেটা কী? একটা গোটা উপজাতি একদিনের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল? তাও কোনো এক পাথুরে মূর্তির অভিশাপে? এরকম হয় নাকি?
‘‘কীভাবে নিশ্চিহ্ন হল শুনি? যুদ্ধ-টুদ্ধ লেগে? ঝড়-ঝঞ্ঝা? অথবা আগুন? নাকি বন্যা?’’
এইবার প্রথমবার একটু অস্বস্তি দেখলাম পরাগের মুখে৷ একটু ইতস্তত করে বলল, ‘‘সেটা ভারী অদ্ভুত কাহিনি দাদা৷ আমাদের দেওরিদের মধ্যে বংশপরম্পরায় এই কাহিনি চলে আসছে৷ এটা শুনলে বুঝবেন কেন কেউ কাউরীবুড়ির মন্দিরে যাওয়ার সাহস করে না৷
আজকাল আমাদের দেখে বিন্দুমাত্র বোঝার উপায় নেই যে কে দিবংগোঁয়্যা আর কেই বা তেঙাপোনিয়া৷ সবাই মিলেমিশে গেছে৷ কিন্তু অনেক আগে সেটা বোঝা যেত৷ তখন চারটে গোষ্ঠী আলাদা আলাদা গ্রামে থাকত৷ এক গোষ্ঠীর লোকজনের পক্ষে অন্য গোষ্ঠীর গ্রামে ইচ্ছেমতো ঢোকা-বেরোনোর ওপর একটা অলিখিত কড়াকড়ির ব্যাপার ছিল৷’’
‘‘তা তোমাদের এই গ্রামগুলো ছিল কোথায়?’’
‘‘এই এখানেই৷ সদিয়া আর তিনসুকিয়া মিলিয়ে৷ যেমন ধরুন আমি জাতিতে দিবংগোঁয়্যা৷ আমাদের আদি গ্রাম ছিল ডুমডুমা বলে একটা জায়গায়৷ এখান থেকে আধঘণ্টার রাস্তা৷’’
‘‘আর পাতরগোঁয়্যাদের?’’
‘‘পাতরগোঁয়্যাদের গ্রামটা ছিল অন্যদের থেকে একটু দূরে, মাগুরি বিলের ধারে৷ জঙ্গলের মধ্যে যে শুখানালাটা আপনি দেখেছিলেন, তার ওপারে৷
পাতরগোঁয়্যারা চিরকালই অন্যদের থেকে একটু তফাতে থাকতে পছন্দ করত, সবার সঙ্গে চট করে মিশত-টিশত না৷ ওদের আচার-আচরণ, বেশভূষা, এসবও ছিল অন্যদের থেকে বেশ খানিকটা আলাদা৷’’
‘‘তাতে বাকিরা, মানে অন্য তিন জাতের লোকজন ওদের নিয়ে কিছু বলত না?’’
‘‘প্রশ্নই ওঠে না! ঘাঁটানো তো দূরে, বাকিরা বরং ওদের একটু ভয়ই পেত৷’’
‘‘কেন? ভয় পেত কেন?’’
‘‘তার দুটো কারণ৷ আপনি তো জানেনই, আমরা এমনিতে পুজো-আচ্চা, ঝাড়ফুঁক, এসবে খুবই বিশ্বাস করি৷ আমাদের বড়দেওরিরাও প্রত্যেকেই তুকতাক ইত্যাদিতে খুব পারদর্শী৷ কিন্তু পাতরগোঁয়্যাদের তুকতাক বা তন্তরমন্তর ছিল বাকিদের থেকে অনেক উঁচু দরের৷ সাধারণ বিষকাটান, বাটিচালা, ধুলাপড়া, বাণমারা এসব ছোটখাটো বিদ্যা তো ছেড়েই দিন৷ বিভিন্ন ঘরোয়া অশান্তির উপশম, সাপে কাটার ওষুধ, বিভিন্ন জটিল মেয়েলি রোগের চিকিৎসা, এসবেও এদের খ্যাতি ছিল সাংঘাতিক৷ আর মারণবিদ্যায় তো কথাই নেই৷ যদি পাতরগোঁয়্যাদের কেউ অন্য জাতের কারও ওপর রুষ্ট হত, তবে আমরা ধরেই নিতাম যে সে আর বেশিদিন বেঁচে নেই৷’’
‘‘এটা তো হল গিয়ে প্রথম কারণ৷ তবে দ্বিতীয়টা?’’
‘‘বলছি সাহেব৷ সেটাই হচ্ছে আসল৷’’
‘‘কী সেটা?’’ প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে আড়চোখে দেখলাম মংকুও উৎকর্ণ হয়ে শুনছে৷
একটু সময় নিল পরাগ৷ চোখ কুঁচকে কী যেন একটা ভাবছিল ও৷ তারপর বলল, ‘‘এককালে আমাদের মধ্যে নরবলির প্রচলন ছিল জানেন তো?’’
‘‘জানি৷ সুটিয়া রাজাদের রাজত্বের সময় দেবী কেচাইখাতির কাছে রেগুলার নরবলি হত৷ বলির মানুষ সাপ্লাই আসত মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামিদের মধ্যে থেকে বা যুদ্ধে হারিয়ে দেওয়া অন্য উপজাতির লোকদের থেকে৷ কি, ঠিক বলেছি তো?’’
‘‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন৷ শুধু জেনে রাখুন যে সেই বলি দেওয়ার অধিকার ছিল একমাত্র পাতরগোঁয়্যাদের৷ আর কারও নয়৷’’
চুপ করে রইলাম৷ এই তথ্যটা জানা ছিল না৷
‘‘আমাদের প্রচলিত উপকথা অনুযায়ী, সেইজন্য পাতরগোঁয়্যারা অন্য জাতের লোকজনকে একটু নীচু নজরে দেখত৷ অন্য জাতের লোকেরাও নাকি পাতরগোঁয়্যাদের গ্রামে বিশেষ একটা যেত-টেত না৷ গেলেও চেষ্টা করত বেলা থাকতে থাকতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজের গ্রামে ফিরে আসা যায়৷’’
ব্যাপারটা উত্তরোত্তর জটিল হয়ে দাঁড়াচ্ছিল৷ এসব উপজাতিদের মধ্যে অনেক গল্পগাছা, কিংবদন্তি, লোককাহিনি ইত্যাদি প্রচলিত আছে জানি৷ কিন্তু এটা তাদের মধ্যে একেবারে অন্যরকম৷
‘‘তবে আরও একটা ব্যাপারে ওরা আমাদের থেকে একদম আলাদা ছিল৷’’
‘‘যেমন?’’
‘‘বড়দেওরি মানে পুরুষ, চিরকাল আমরা এই দেখে এসেছি৷ কিন্তু ওদের সমাজ চালাত মেয়েরা৷ মেয়েরাই ওদের বড়দেওরি হতেন৷ একজন বড়দেওরি মরে গেলে তাঁর বড় মেয়ে পরের বড়দেওরি হতেন, এইভাবে চলত৷’’
শোনামাত্র নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে এল আমার৷ কালকেই এই কথাটা শুনেছি না? কিন্তু সেটা ওকে বুঝতে দিলাম না৷
‘‘সে তো বুঝলাম৷ কিন্তু তুমি আসল গল্পটাই বললে না যে৷ পাতরগোঁয়্যারা সবাই একদিনের মধ্যে উধাও হয়ে গেল কী করে?’’
ফের খানিকক্ষণ চুপ করে রইল পরাগ৷ তারপর গলা নামিয়ে ধীরে ধীরে বলল, ‘‘ওদের দেবী যে রুষ্ট হয়ে খুব সাংঘাতিক একটা অভিশাপ দিয়েছেন সে খবর আমরা অন্যভাবে পেয়েছিলাম বটে৷ কিন্তু সেই রাতে কেউ আর ভয়ে ওদের গ্রামের রাস্তা মাড়ায়নি৷’’
‘‘হুম৷ তারপর?’’
‘‘সে রাতটা ছিল কার্তিক মাসের চতুর্দশী, রাত পেরোলেই অমাবস্যা৷ পরের দিন সকালে বাকি তিনটে গোষ্ঠীর গাঁওবুড়ো আর পারিয়া-রা বাছা বাছা কয়েকজন সাহসী পুরুষ সঙ্গে নিয়ে রওনা দিল পাতরগোঁয়্যাদের গ্রামের উদ্দেশে৷ হাজার হোক, ওরাও দেওরি, বালিয়াবাবা আর তাম্রেশ্বরীর লোক বলে কথা৷ কী হল না হল সেটা তো একবার দেখে আসতে হয়, না কি?’’
‘‘তারপর?’’ আমার গা বেয়ে নিজের অজান্তেই একটা শিরশিরানি ভাব উঠে আসছিল৷